২০১৫ সালে সুইডেনের সভারিয়াস রিক্সব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে অর্থনীতিতে পুরস্কারটি পেয়েছেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূদ মার্কিন অর্থনীতিবিদ আঙ্গাস ডিটন। নোবেল কমিটির ভাষ্য অনুযায়ী ডিটন তার ‘ভোগ, দারিদ্র্য ও কল্যাণ বিষয়ক বিশ্লেষণের’ জন্য এ পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৬৯ সালে শুরু হয়ে এ-যাবত্ যে ৪৭ বার এ পুরস্কার ঘোষণা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছেন ৭৬ জন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ। ১৯৮৭ সালে কানাডায় পিএইচডি পড়ার সময় তার ‘Ananlysis of Consumption Behavior’ বইটি পড়েছিলাম। বইটি প্রকাশ হয়েছিল ১৯৮০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে। বইটি তখন মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয়েছিল। কারণ তখনকার দিনে অর্থনীতিতে তত্ত্বগত অবস্থান বজায় রেখে কীভাবে মানুষের ভোগের বিশ্লেষণ করা যায়, তা জানতেই বইটি আমাদের পাঠ্য করা হয়েছিল। কী তার বিশ্লেষণ, তা নিয়ে পরে আসছি। তবে শুরুতেই আরো কিছু কথা।
ক’দিন আগে ঢাকায় একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম শহরে অতিদারিদ্র্য বিষয়ে আলোচনা শুনতে। আগামী দিনে পর্যায়ক্রমে গ্রাম থেকে বহু মানুষ শহরে আসবে। সেই আগামীর জন্য কী করা যায়, তা চিহ্নিত করতেই এ সেমিনার। সেমিনারের উদ্যোক্তা উন্নয়ন সমুন্নয়। সহযোগিতা করেছিল সিঁড়ি নামে একটি সংস্থা, যারা বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করছে এবং ২০২২ সালের মধ্যে দেশ থেকে অতিদারিদ্র্য দূর করার উপায় বিশ্লেষণ করছে। বুঝতেই পারছেন, ডিটনের সেই গবেষণার বিষয়ও ছিল এ রকমই। সেমিনারে সাধারণত থাকেন প্রবন্ধ উপস্থাপক, সঞ্চালক, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি। এখানেও সবাই ছিলেন। ছিলেন ঢাকার এক মেয়র। ছিলেন সংসদ সদস্য, এনজিও এবং দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, পৌর কমিশনার। আরো ছিলেন কিছু অতিদরিদ্র নারী ও পুরষ, যাদের এনজিওগুলো তাদের প্রজেক্টের মাধ্যমে দেখভাল করে আসছে। সেখানে বসেই মনে পড়ল ডিটন ও তার গবেষণার কথা।
তিনি গবেষণার মাধ্যমে মানুষের ভোগের বিশ্লেষণ করে অর্থশাস্ত্র ও বিশেষ করে উন্নয়ন অর্থনীতিতে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ করেছেন। এজন্যই তাকে পুরস্কার দেয়া হয়েছে। তার বিশ্লেষণের একটি প্রধান দিক ছিল, কী করে মানুষ তার ভোগের বিন্যাস করে তা দেখা। ফলে তার বিশ্লেষণ ভোক্তার চাহিদা বিশ্লেষণে একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছিল। তার একটি বিশ্লেষণ ধারণা ছিল, Almost Ideal Demand System (AIDS), যার সহজ কাঠামো দামের পরিবর্তনে সঙ্গে চাহিদার কী পরিবর্তন হয়, তার ব্যাখ্যা ও ভোক্তার আচরণ বিশ্লেষণ এখন একটি প্রমিত ধারণায় পরিণত হয়েছে।
পারিবারিক আয়-ব্যয়ের পরিবর্তন কী করে অর্থনীতির গতি পরিবর্তন করে। কীভাবে পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, কোন চাহিদা কী করে পূরণ করবে, কিংবা কী করে পারিবারিক হিসাবকে ভিত্তি করে সামগ্রিক চাহিদার চিত্র পাওয়া যায়, এ বিষয়ে ধারণা তৈরি করতে ডিটনের বিশ্লেষণ আমাদের সাহায্য করে। বাংলাদেশ পাঁচ বছর অন্তর দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের জন্য একটি পারিবারিক আয়-ব্যয়ের উপাত্ত সংগ্রহ করে। তা থেকেই আমরা শেষ পর্যন্ত বলি, আমাদের অর্থনীতির গতি কোন দিকে পরিবর্তিত হচ্ছে বা হবে। এ তথ্যের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ বিভিন্ন নীতিপ্রণয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। তবে বাংলাদেশে এ বিষয়ে গবেষণা কেবল দারিদ্র্য বিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণেই সীমাবদ্ধ।
বলছিলাম দারিদ্র্য বিষয়ক সেমিনারে অংশগ্রহণের কথা। আমার এক বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তৈয়বুর রহমান বক্তব্য রাখছিলেন। উপস্থাপনার একাংশে তিনি জানালেন, HIES তথ্য অনুযায়ী শহরাঞ্চলে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে ৪৭ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে ঢাকায়, যা ছিল ৬০ শতাংশ। এর পর চট্টগ্রাম ও সিলেটে, যা ছিল ৫০ শতাংশ আর সবচেয়ে কম অতিদারিদ্র্য কমেছে বরিশালে, যা মাত্র ৮ শতাংশ। দারিদ্র্যের পরিবর্তনের এ বিরাট ব্যবধান চোখে পড়ার মতো। উপস্থিত অনেকেরই চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তবে ড. তৈয়বুর রহমানের পরবর্তী স্লাইডের জন্য সম্ভবত কেউই তৈরি ছিল না। তিনি বললেন, শহরে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ২৭ লাখ। বোমার ফাটার মতো অবস্থা। প্রধান অতিথি নড়েচড়ে বসলেন। সঞ্চালক বিব্রত চোখে বললেন, শূন্য একটি কম হয়েছে হয়তোবা। [গবেষক মিলিয়ন আর লাখকে গুলিয়ে ফেলেছেন!] আমি নিজেও মোবাইলে ক্যালকুলেটর নিয়ে বসলাম! সত্যি কি মাত্র ২৭ লাখ লোক এখন অতিদরিদ্র। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি বা ১৬০ মিলিয়ন। তাকে থামিয়ে দিলেন প্রধান অতিথি। বললেন, মাত্র ২৭ লাখ! [হয়তোবা মনে মনে বলছিলেন, ‘তাহলে তো আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হয়েই গেলাম!’] পেছন থেকে দরিদ্র জনগণ চিত্কার করে উঠল, হতেই পারে না। এ সংখ্যা ভুল। [দারিদ্র্য সম্পর্কে ধারণাই নেই গবেষকের!] সঞ্চালক পরিস্থিতি সামলাতে ব্যস্ত। বললেন, হয়তোবা সংখ্যা একটু ভুল হয়েছে, তবে ঠিক করা যাবে। ততক্ষণে আমার ক্যালকুলেটর টেপা শেষ। গণনা সঠিক। আমাদের পারিবারিক আয়-ব্যয়ের যে উপাত্ত আমাদের হাতে আছে, আমাদের জনসংখ্যার যে পরিমাণ শহরে বাস করে, তার হিসাব মেলালে সংখ্যাটি সঠিক। ইশারা করছিলাম গবেষককে যে, তিনি যেন তার সংখ্যায় স্থির থাকেন। তিনি দেখতে পাননি। তবে তিনি বললেন, আমার ধারণা আমার সংখ্যা সঠিক, তবে আপনারা যেহেতু বলছেন, তাই আমি সংখ্যাটি আবার পরীক্ষা করে দেখব।
কেন বললাম এতগুলো কথা? কারণ সেই আঙ্গাস ডিটন, তার ধারণায় জনগণের আয়-ব্যয়ের সঠিক বিশ্লেষণই সঠিক নীতি তৈরিতে সহায়তা করে। উপাত্ত না নিয়ে কিংবা ভ্রান্ত উপাত্ত বা ব্যক্তির কল্পিত ডাটার ওপর ভিত্তি করে যদি নীতিপ্রণয়ন হয়, তবে তা শেষ পর্যন্ত কোনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। এটাই ছিল ডিটনের মূলমন্ত্র। ডিটন দেখিয়েছিলেন যে, HIES বা সমজাতীয় উপাত্ত ব্যবহার করে কী করে দারিদ্র্য পরিমাপ করা যায়, কী করে বোঝা যায়, সমাজে বৈষম্য রয়েছে কিনা? কিংবা সমাজে কোনো লিঙ্গবৈষম্য রয়েছে কিনা? ইত্যাদি ইত্যাদি।
২০১৫ সালেও আমরা তা শিখতে পারিনি। সর্বত্রই আমরা নিজেদের তৈরি উপাত্ত দিয়ে নীতি প্রণয়ন করে যাচ্ছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই যথাযথ সাফল্য আমরা দেখতে পাই না। পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৫ সালে নতুন HIES সার্ভে করছে। ফলে ২০১০-পরবর্তী সাফল্য সম্পর্কে আমরা জানতে পারব। অনেক সময় দেখেছি, আমাদের প্রথিতযশা ব্যক্তিরাও ভুল সংখ্যার দ্বারা নীতি ব্যাখ্যা দেন, যা একেবারেই করা উচিত না। আবার অনেকে প্রমিত নিয়ম অনুযায়ী, উপাত্ত সংগ্রহ না করে যেনতেন উপাত্ত ব্যবহার করে নানা অপব্যাখ্যা দেন। আঙ্গাস ডিটনকে এবারের নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্ভবত আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয়া হলো যে, সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা সব নীতিপ্রণয়নের জন্য জরুরি। LSMS/HIES জাতীয় জরিপ থেকে কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যায়, তা নিয়েও ডিটন একটি বই লিখেছেন।
৭০ বছর বয়সী এ অধ্যাপক কিন্তু এখনো একজন ব্যস্ত গবেষক। গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্য অনুযায়ী ডিটন ও তার স্ত্রী এনি কেউস বিভিন্ন উপাত্ত সংগ্রহ করে বলছেন যে, আমেরিকার মধ্যবয়সী সাদা লোকদের মৃত্যুহার ক্রমে বাড়ছে এবং তা এখন কালো ছাড়া অন্য সব আমেরিকানের চেয়ে বেশি। বিশ্লেষণ করে তারা আরো বলছেন যে, এ অবস্থার জন্য ডায়াবেটিস বা হূদরোগ দায়ী নয়; দায়ী তাদের অতিমাত্রায় আত্মহত্যার প্রবণতা ও ড্রাগ বা অ্যালকোহল ব্যবহারজনিত যকৃতের রোগ। গবেষণা করে তারা আরো বলছেন, সাদা ও কম শিক্ষিত আমেরিকানদের ভাগ্য বিড়ম্বনাই এজন্য দায়ী।
তবে তার একটি সুপাঠ্য বই হলো The Great Escape. আমরা যখন বলছি সমাজে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে, আমাদের আয়ু বাড়ছে, অর্থনীতি থেকে ক্রমে গরিবের সংখ্যা কমছে, তখন তিনি এ বইয়ে কতগুলো সত্য সবার জন্য তুলে ধরেছেন। ধনী দেশেও যে আয়বৈষম্য রয়েছে, তার বর্ণনা তিনি করেছেন, বলেছেন চীন ও আমেরিকায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সমস্যার কথা, বলেছেন আফ্রিকার এইডস সমস্যার কথা। বইটির অনেকটা জুড়ে রয়েছে এসব সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে তার মতামত। তার মূলমন্ত্র কিন্তু আশার বাণী। তিনি বর্ণনা করেছেন, আমরা কীভাবে বেঁচে থাকি, কতটুকু সুখী, কতটুকু সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। আরো বলেছেন, আমরা কখনই এর চেয়ে ভালো ছিলাম না। এতসবের মধ্যেও আমাদের অবস্থা দিন দিন ভালোই হচ্ছে। আমরা ক্রমে ভালোর পথে এগোচ্ছি।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি