পানামা পেপারস নামে যে তথ্যগুলো সম্প্রতি সংবাদপত্রের পাতায় প্রথম সারিতে এসেছে, তা নিয়ে আমাদের অনেকের ঘুম হচ্ছে না। ঘুম হচ্ছে না সংবাদপত্রসেবীদের, যাদের কাজ হচ্ছে খুঁজে বের করা নিজ বা অন্য দেশের কোন কোন ব্যক্তি জড়িত তা প্রকাশ করা। গোপনীয়তার একটি মজার দিক হলো, এটি ফাঁস হয়ে গেলে সবাই একবার দেখতে চায়। তাই যাদের এ ‘কেলেঙ্কারি’র সাতে-পাঁচে থাকার কথাও নেই, তারাও নিয়মিত ঘুম হারাম করে ইন্টারনেটে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কার নাম পাওয়া যায়। পানামা পেপারস বের হওয়ার পর এ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাই অন্তত একবার বলেছেন যে, তারা এর সঙ্গে জড়িত নন। তাতেও কিছু হয়নি, সবার আকর্ষণ আরো দ্বিগুণ হয়েছে! আরো খোঁজাখুঁজি হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় অর্ধশত মানুষের নাম রয়েছে এ তালিকায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারো নাম বাংলাদেশের ঠিকানায়, কারো নাম আছে বিদেশ— সিঙ্গাপুর, আমেরিকা ইত্যাদি ঠিকানায়। পানামা পেপারস নিয়ে কার্টুনও বেরিয়েছে। এরই মধ্যে শিকার হয়েছেন বিশ্বের বেশকিছু নেতা। কেউ কেউ চেষ্টা করছেন, কী করে ব্যাখ্যা করা যায়। কারো বাবার নাম আছে, কারো বন্ধুর, কারো স্ত্রীর বা কারো মেয়ের নাম আছে। সব মিলিয়ে সবাই যেন রহস্য গল্প পড়ার চেষ্টা করছে। কী এই পানামা পেপারস, কেনইবা এই লোকেরা পানামা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, বাহামা বা ক্যামন আইল্যান্ডে টাকা লুকাচ্ছেন; তার অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার জন্য এ লেখা।
২০১৩ সাল। তখন সবেমাত্র পত্রিকায় জানা যায় যে ফনসেকার কম্পিউটার সিস্টেম থেকে তথ্য বের হয়ে গেছে। বিব্রত বিভিন্ন গ্রাহক ফোনে জানতে চান ফনসেকার কাছে তাদের অ্যাকাউন্ট কতটা নিরাপদ? ফনসেকার কর্মকর্তার স্পষ্ট জবাব— আমাদের রয়েছে ‘স্টেট অব দি আর্ট’ টেকনোলজি এবং ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ’ এনক্রিপশন টেকনোলজি; আমাদের কাছে দেয়া তথ্য খুবই নিরাপদ। তারা জানতেন না যে, তত দিনে তাদের গত ৪০ বছরের প্রায় ১১৫ লাখ গ্রাহকের তথ্য পাচার হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধানী সাংবাদিকদের মোর্চা আইসিআইজের হাতে। ২০১৩ সালে পাওয়া তথ্যকে খোলাসা করতে তাদের সময় লাগে প্রায় দুই বছর। প্রশ্ন আসতে পারে— এসব তথ্য কোন সময়ের? জানামতে, তা ২০১০ সাল পর্যন্ত। অর্থাত্ পানামা পেপারসে প্রকাশিত তথ্যে ২০১০-এর পর কিছু নেই। এনক্রিপটেড তথ্য থেকে আসল তথ্য বের করতে সংস্থাটিকে ব্যয় করতে হয়েছে বহু সময়, নিয়োজিত করতে হয়েছে বহু কম্পিউটার বিজ্ঞানীকে। অতঃপর? অতঃপর এখন সব তথ্যই বিনা পয়সায় পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ-যাবত্ মাত্র কয়েক হাজার লোকের তথ্য সাংবাদিকরা প্রকাশ করেছেন। বাকিদের নাম হয় ইচ্ছেকৃতভাবে গোপন রাখা হয়েছে, নচেত্ ভবিষ্যতে মোক্ষম সময়ে প্রকাশ করা হবে। তাদের ওয়েবসাইটে গেলেই তা পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে কেউ বলছেন, এটি সিআইএর কাণ্ড। তবে কেন?
বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস মোকাবেলার জন্য সিআইএ নিয়োজিত (অনেকের মতে, সন্ত্রাস তৈরিতেও তারা জড়িত)। দুই দশক ধরে বিশ্বব্যাপী যেসব সন্ত্রাসী কাণ্ড চলছে, তার আর্থিক লেনদেন হবেই। কে দিচ্ছে, কোথা থেকে দিচ্ছে। তার খোঁজে সিআইএ থাকবেই তা নতুন ঘটনা নয়। মজার কথা হলো, ফনসেকা পানামার মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান। আরো হাজারো প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের মাধ্যমে আরো বহু লাখ অ্যাকাউন্ট রয়েছে পানামা বা এসব রাষ্ট্রে। প্রকাশিত এ তালিকায় নাম না থাকলেই যে সবাই নিরাপদ তা কিন্তু নয়। হ্যাকিং আবারো হবে। আবারো প্রকাশিত হবে নতুন কারো নাম। অথবা বাকিদের নাম প্রকাশিত হবে।
যে বিষয়টি নিয়ে আমরা সবাই মাথা ফাটাচ্ছি তা কিন্তু অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। ফনসেকা কি অন্যায় বা বেআইনি কিছু করেছে? কিংবা পানামা কি পৃথিবীর সব অপরাধীর কার্যঠিকানা? কেনইবা ডেভিড ক্যামেরনের বাবা সেখানে অ্যাকাউন্ট করেছিলেন? তার অর্থ কি অন্যায়ভাবে অর্জিত হয়েছিল?
গত সংখ্যার ইকোনমিস্ট পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী প্রকাশিত পানামা পেপারসে রয়েছে ১৪০ জন রাজনীতিবিদ বা সরকারি কর্মকর্তার নাম, যার মধ্যে ১২ জন কোনো দেশের রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী আছেন। এ তালিকায় আছে ৩৩টি কোম্পানি, যাদের সম্পদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ২০ বছরে বাজেয়াপ্ত বা নিষিদ্ধ করেছে। কারণ তারা সন্ত্রাস কিংবা ড্রাগ বিষয়ে জড়িত বা তাদের নিষিদ্ধ কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা আছে বা তাদের প্রতিষ্ঠান। তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের নামও। ডেভিড ক্যামেরন, জ্যাকব জুমা, সৌদি বাদশার নাম যেমন আছে, তেমনি আছে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট কিংবা পুতিনের বা চীনের প্রেসিডেন্টের আত্মীয়দের নাম। পানামা পেপারসকে ব্যাখ্যা করার একটি সহজ উপায় হলো, আমাদের মাটির ব্যাংকের সঙ্গে তার তুলনা করা। মনে করুন, কোনো ছেলে তার অর্থ গোপনে মাটির ব্যাংকে বা বালিশের নিচে রেখেছিল। হতেই পারে তা অন্যায় কিছু। কিন্তু ধরুন, তার মা অথবা বাবা তা একদিন আবিষ্কার করে ফেলল। ধরা পড়ার পর ছেলের অবস্থা কী হবে? বিব্রত হবে নিশ্চিত, তবে অন্যায় হয়েছে কি? অনেকেই তার সম্পদ ব্যাংক কিংবা প্রতিষ্ঠানে রাখতে চান না, তার এ সম্পদ তিনি কী করবেন? কেউ কেনে জমি, কেউ কেনে শেয়ার, কেউ কেনে স্বর্ণ, কেউ কেনে বিদেশে সেকেন্ড হোম কিংবা কেউ রাখে মাটির ব্যাংকে। একদিন কেউ যদি মাটির ব্যাংকের খোঁজ পায় তবে যেমন অবাক হবে, তেমনি হবে পানামা পেপারস পড়ে। প্রশ্ন হলো, কে এই লোকগুলো? এরা কী করে পারল?
প্রথমে প্রশ্ন করুন, পানামায় কোম্পানি করা কি অপরাধ বা বেআইনি? নিশ্চয় নয়। যেকোনো লোক বিশ্বে যেকোনো দেশে বিনিয়োগ করতে পারে। তা অপরাধ নয়। অপরাধ হবে যদি সে তা বেআইনিভাবে অর্জন করে থাকে। তাই তো ১১৫ লাখ গ্রাহকের তালিকার মধ্যে আলোচিত নাম কিন্তু মাত্র ১৪০টি। কোম্পানিগুলো কর উপদেষ্টা পোষে কেন? করভার কমানোর জন্য। কর নীতিমালায় করভার কমানোর নানা ফাঁকফোকর রয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হলো আইনগত পন্থায় যেন কর কমানো যায়। অফশোর অ্যাকাউন্ট এরই একটি পন্থা। তাই লাখ লাখ কোম্পানির অ্যাকাউন্ট নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব মাতামাতি করছে না। যেকোনো দেশে করের বোঝা বেশি হলে ব্যক্তি কিংবা কোম্পানি কর কমিয়ে আনতে নানা পথের আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশে একটি কোম্পানি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা ভারতে তার কোম্পানি রেজিস্টার করে, তা কি অপরাধ? না, তা অপরাধ নয়। আর কেউ তা করতে গিয়ে যদি দেখে মালয়েশিয়ায় রেজিস্টার করলে ৪০ শতাংশ, আমিরাতে করলে ১০ ও পানামায় করলে শূন্য শতাংশ কর দিতে হবে— সব বিবেচনায় যদি সে মনে করে পানামায় রেজিস্টার করা উচিত, তাহলে কি অপরাধ হবে? না, তা হবে না।
তাহলে? বোঝা গেল পানামা পেপারসে নাম থাকলেই তা অপরাধ হবে না। কিছুদিন আগে আমার কাছে এক কোম্পানি এসেছিল একটি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। ব্রিটিশ কোম্পানি, সিঙ্গাপুরে অফিস— মালয়েশিয়ায় ব্যাংক। বুঝতেই পারছেন ব্রিটিশ কোম্পানিটি সিঙ্গাপুরকে তার অফিস হিসেবে বেছে নিয়েছে। আর ব্যাংক হিসেবে বেছে নিয়েছে একটি মালয়েশিয়ান ব্যাংককে। আলোচনার এক পর্যায়ে লক্ষ করলাম কোম্পানিটির রেজিস্ট্রেশন ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে। জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, করভার কমানোর জন্য কোম্পানিটি সেখানে রেজিস্ট্রি করিয়েছে। কোম্পানিকে অপরাধী বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। দ্বৈত কর রেয়াতের জন্য এসব রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বের বহু রাষ্ট্রের চুক্তিও হয়েছে। খোদ আইসিআইজের ওয়েবসাইটে যখন খুঁজতে যাবেন তখন তারা আপনাকে দিয়ে একটি অঙ্গীকার করিয়ে নেয়— ‘এ তালিকায় নাম থাকা মানে এই নয় যে কোম্পানি, রাষ্ট্র বা ব্যক্তি আইন ভঙ্গ করেছে। আমি তা বুঝি।’ প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, এখন পর্যন্ত প্রকাশিত এ তালিকায় প্রায় ৮ হাজার ৩০০টি ব্রিটিশ, ৪ হাজার ৫০০টি যুক্তরাষ্ট্রের, ৯টি সিরিয়ান, ৬০টি সুইডেনের, ৫০০টি ভারতীয়, ২ হাজার ১০০টি রাশান প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, কেন তাহলে বিশ্বের এই ১৪০টি বা সমসংখ্যক কোম্পানি বা ব্যক্তি নিয়ে মাতামাতি। কারণ তিন ধরনের— এক. তারা হয়তো অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত। তাদের অর্থ গোটা পৃথিবীতে সন্ত্রাস বাড়াচ্ছে। তাই তাদের ধরতে গিয়েই এই গোমর ফাঁস হয়ে গেছে। কথায় বলে, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে গেছে। দুই. কোনো কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তি হয়তোবা অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত নয়, তবে নিজের দেশে আইন নিষিদ্ধ পন্থা বা উপায়ে বিত্তশালী হয়েছে। (যেমন রাজনৈতিক ক্ষমতা) তারা তাদের অর্থ লুকানোর জন্য একটি মাটির ব্যাংক খুঁজছিলেন আর ফনসেকা সেই মাটির ব্যাংকের একটি। তিন. হয়তোবা কোনো কোনো কোম্পানি তার দেশের রাজনীতিকদের ঘুষ দেয়ার জন্য একটি লেনদেনের ঘাঁটি খুঁজছিল। একসময় তা ছিল সুইজারল্যান্ডে আর এখন সেই সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো কিছু নতুন দেশ— পানামা, বাহামা সে রকম কয়েকটি দেশ।
পানামা পেপারস প্রকাশিত হওয়ার আগেও লুক্সেমবার্গ লিকস কিংবা সুইস লিকস নামে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তাই এটি ভাবা ঠিক হবে না যে, এর পর পৃথিবীতে আর কোনো মাটির ব্যাংক তৈরি হবে না। আমাদের ভাবা উচিত কেন কোম্পানি বা ব্যক্তি এ কাজ করছে? তা না হলে এ মুহূর্তে কেউ কেউ হয়তোবা বিব্রত হচ্ছেন আর আগামীতে অন্য কেউ বিব্রত হবেন তা বলা বাহুল্য। আমার কাছে এর বেশি কিছু না।
আমাদের কাছে মুখ্য প্রশ্ন, কেন কোম্পানি বা ব্যক্তি বা রাজনীতিবিদ পানামায় টাকা পাঠাচ্ছেন? বুদ্ধিমান রাষ্ট্র প্রথমেই এ প্রশ্নের সমাধান খুঁজবে। প্রথমত. বুঝতে হবে বাংলাদেশ বা সমজাতীয় দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠানো সহজ নয়। কোম্পানিগুলো তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশে লেনদেন করতে গিয়ে এ-জাতীয় অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। তা অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের কোনো এক কোম্পানির এ রকম একটি অ্যাকাউন্টকে বলা হয়েছে Sundry Account. বলা হয়েছে, It is an internal account created by the offshore services firm to record miscellaneous charges of an officer or master client. বুঝতেই পারছেন যে, ঘুষজাতীয় লেনদেনের জন্য এ অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়েছে। আরো একটি কোম্পানির ঠিকানা বাংলাদেশে নয়, তবে ডাটাবেজ ঘেঁটে বোঝা যায় তা ঢাকা ও চট্টগ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় সব অ্যাকাউন্টের লেনদেনের ক্ষেত্রে দেখা যায়— বি-১, বি-২ বা bearer ১, bearer ২ ইত্যাদি নামের সঙ্গে লেনদেন হয়েছে। কারা এই বি-১ বা বি-২, তা ডাটাবেজে আপাতত দেখা যায় না। তবে বোঝা যায় যে, ঘুষজাতীয় লেনদেন কিংবা রাজনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো কোনো কোম্পানি এ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছে।
দ্বিতীয়ত. ঘুষের বাইরে কি অন্য কোনো কারণ রয়েছে? হতে পারে আয়কর রেয়াত পাওয়ার জন্য এই অফশোর অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়েছে। তবে পানামার আয়কর ২৫ শতাংশ অর্থাত্ যা বাংলাদেশের সমান। তাই ব্যক্তি তার আয়কর অব্যাহতির জন্য পানামাকে ব্যবহার করার কোনো কারণ খুঁজে পাবে না। বাহামায় আয়কর শূন্য। তবে সেখানে রয়েছে মাস্তান, যা আমাদের চেয়ে ভয়ঙ্কর। আর পানামায় করপোরেট কর প্রায় ৪০ শতাংশ। শুধু তাই নয়, কোনো কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা না দিলে কর আরো বেড়ে যায়। স্পষ্টত কর ফাঁকির জন্য বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর পানামা যাওয়ার দরকার নেই।
তৃতীয়ত. কোম্পানি নানা ধরনের আন্তর্জাতিক লেনদেন করে থাকে। এসব লেনদেনে সময়ক্ষেপণ আত্মঘাতী হয়। তাই কোম্পানিগুলো চায় অতি সহজে কোনো অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে লেনদেন সারতে। বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক লেনদেন করা দুরূহ। আগেও বলেছি, টাকা যদি আসেও তবে আপনাকে বেশ কয়েকটি ফর্ম পূরণ করতে হবে। আর পাঠাতে গেলে? বলা বাহুল্য, তাই অনেকেই অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রাখেন। টাকা পাঠানোর জন্য কেবল যারা রফতানি করেন তাদের পক্ষে তা অনেকটা সহজ। তাই আন্তর্জাতিক লেনদেন সারতে কোম্পানি বা ব্যক্তি এ ধরনের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে থাকে। যেমন ধরুন, একটি আর্কিটেক্ট ফার্ম কোনো একটি দেশে কন্ট্রাক্ট পেতে চেষ্টা করছে, তারা তাদের কাজের জন্য সে দেশে যাবে এবং নানা ধরনের লেনদেন (ঘুষ ছাড়াও) করবে। আমাদের দেশ থেকে তারা এ টাকা পাঠাতে পারবে, তবে অনেক কষ্টে। সেক্ষেত্রে কোম্পানি এ ধরনের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে থাকে। আর সেই কাজ পেলে তারা দেশে বসেই কাজটি করে দেবে। দেশে আসবে বৈদেশিক মুদ্রা। এতে দেশের ক্ষতি হয় না। বরং দেশের লাভ হয়। আরো একটি উদাহরণ দিই, বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ যুবক এখন ওডেস্কে নিয়মিত কাজ করছে। তারা যে পারিশ্রমিক পাচ্ছে তা অনেকের জন্যই খুব বেশি নয়। যারা কাজ দেয়, তারা নিয়মিতভাবে পারিশ্রমিক পাঠাতে চায়। কারো জন্য তা ৫০, ১০০ ডলার, কারো জন্য ১ হাজার ডলার। দেশে টাকা আনার ক্ষেত্রে তা যদি ব্যাংকের মাধ্যমে আসে তবে কয়েক দফা ফর্ম পূরণ করতে হয়। তার ওপর রয়েছে ১০ শতাংশ কর (তার আয় করযোগ্য হোক বা না হোক)। আবার নিয়োগকর্তা স্বল্প পরিমাণ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে চায় না। কারণ তার জন্য অতিরিক্ত ফি দিতে হয়। আমাদের যুবক এই টাকা যদি ফি বাদ দিয়ে গ্রহণ করে, তবে তার কিছুই থাকে না। তারা কী করে? বিট কয়েন, পেপাল কিংবা অন্য কোনো উপায়ে এ অর্থ গ্রহণ করে। অথচ বিদেশ থেকে এ অর্থ পৃথিবীর বহু দেশেই সহজে গ্রহণ করার নিয়ম চালু হয়েছে। অন্যথায় এসব যুবক-যুবতী একসময় দেশ ছেড়ে পালাবে।
চতুর্থত. অনেক বাংলাদেশী বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে না। তারা তাই তাদের আত্মীয়-পরিজনকে (মূলত স্ত্রী ও সন্তান) বিদেশে পাঠাতে চায়। সেখানে সন্তানের নিরাপত্তা খোঁজে। সন্তানের জন্ম যেন আমেরিকায় হয়, সেজন্য কত ধরনের নিয়মনীতি যে তারা পালন করে তা জানলে তাক লাগবে অনেকের। বিদেশে চিকিত্সা, বিদেশে লেখাপড়া, বিদেশে পাড়ি দেয়া ইত্যাদির জন্য সে দেশে টাকা পাঠানোর প্রয়োজন। তাই তারা আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে ওভার বা আন্ডার ইনভয়েসিং করে থাকে। তাদের টাকা রাখার জন্য প্রয়োজন অফশোর অ্যাকাউন্ট।
অতএব পানামা পেপারস নিয়ে উত্সাহিত না হয়ে আমাদের উচিত অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করা। আমার প্রস্তাব সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে একটি সফল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আমাদের আর্থিক সংস্কারের বিকল্প নেই। আশা করি, সরকার প্রস্তাবটি বিবেচনায় আনবে।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়