সম্পাদকীয়
ব্রেক্সিটে আমাদের কী হবে?
গত ২৩ জুন যুক্তরাজ্যে ইউরোপ বিষয়ে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাতে খোদ যুক্তরাজ্যবাসীসহ বিশ্বের সবাই অবাক হয়েছে। ২৩ জুনেরও প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে থেকে আমি ভোটের বিষয়ে খবর পাচ্ছিলাম। আমার যুক্তরাজ্যবাসী স্বজনরা বেশ উত্সাহের সঙ্গে ব্রেক্সিট ‘না’ অর্থাত্ গণভোটে ইউরোপে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। তাদের কথোপকথন থেকে বুঝতে পারছিলাম যে, অল্প বয়সীদের অনেকেই ইউরোপে থাকার পক্ষে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। যুক্তরাজ্য ৫২ শতাংশ ভোটে ইউরোপ হতে বের হয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে। প্রায় ৭১ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে, যা গত ৩০ বছরের যেকোনো ভোটের চেয়ে বেশি। ১৯৯২ সালের পর এত বেশি সংখ্যক ভোটার কখনই ভোট দেয়নি। সেই অর্থে এ গণভোট প্রকৃত অর্থেই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। তবে ভোট শেষে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে খোদ ব্রিটেনেই। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। লেবার পার্টির নেতা করবিন শেষ পর্যন্ত তার সংসদীয় দলের এমপিদের আস্থা হারিয়েছেন। স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড এখন পরবর্তী অবস্থান নিয়ে ভাবছে। কারণ তাদের রাজ্যের অধিকাংশ ভোটার ইউরোপের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ইউরোপের পেটের মধ্যে থাকা ব্রিটিশ উপনিবেশ জিব্রাল্টার নিয়ে এরই মধ্যেই স্পেন প্রশ্ন তুলেছে। একই সঙ্গে ইউরোপও তাদের অবস্থান শক্ত করেছে। বলেছে যে, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় বাজার ত্যাগের নোটিস না দেয়ার আগে কোনো আলোচনা করবে না। এদিকে ইউরোপের কোনো কোনো দেশ যেমন নেদারল্যান্ডস, ইতালি, গ্রিস ও সুইডেনও গণভোটের চিন্তাভাবনা করছে। পাশাপাশি পাউন্ড তার মূল্য হারাচ্ছে। চীনসহ বহু দেশ যেকোনো নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশেরও অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আমাদের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে। এ অবস্থায় আমার আজকের আলোচনার উদ্দেশ্য, বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট করা।
যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ রাজনৈতিকভাবে কখনই এক ছিল না। ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক মতপার্থক্য আমরা সবসময়ই দেখতে পেয়েছি। কুয়েত, লিবিয়া, ইরাক এমনকি সিরিয়া বা রাশিয়া বিষয়ে যুক্তরাজ্য অনেক সময়ই ইউরোপের সঙ্গে একমত ছিল না। বস্তুত অনেক সময়ই যুক্তরাজ্যের চাপে ইউরোপ তার অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে ঠাণ্ডা বিরোধ সবসময়ই ছিল। কিন্তু তার পরও যুক্তরাজ্য ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, তাই তার মত মানতে ইউরোপ অনেক সময়ই বাধ্য হয়েছে। এ অবস্থায় যুক্তরাজ্যের ইউরোপ ত্যাগ ইউরোপের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গণভোটের পর এক সপ্তাহের মধ্যে ইইউর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সভা তারই ব্যাখ্যা করে। যুক্তরাজ্যের ইইউ ত্যাগ দুই পক্ষের জন্যই একটি বিশাল ঘটনা। তবে ঘটনার সূত্রপাত যুক্তরাজ্য থেকে।
কবে এ আনুষ্ঠানিক তালাক বা বিচ্ছেদ সম্পন্ন হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সাধারণ ধারণায় তা শেষ হতে প্রায় দুবছর সময় লাগবে। কথায় বলে, বিবাহের চেয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ অনেক পীড়াদায়ক এবং সময়সাপেক্ষ। একই সঙ্গে বিচ্ছেদের এ সময়ে দুপক্ষই চাইবে তাদের নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে। তাই শেষ পর্যন্ত আগামী দুই বছরে ঘটনার সম্ভাব্য প্রভাব কতটুকু হবে, তা নিয়ে আমার এখনো সন্দেহ রয়েছে। তবে এর সূত্র ধরে নেদারল্যান্ডস বা ডেনমার্ক বেরিয়ে গেলে ইইউ যে ভেঙ্গে পড়বে, তা প্রায় নিশ্চিত। ইইউ কি তা বোঝে না? নিশ্চয়ই তা বোঝে এবং তাই আগামী দিনগুলোয় ইইউ যে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করবে, তা হলপ করে বলা যায়। জার্মানি কিংবা ফ্রান্স কিংবা স্পেন সবাই চাইবে ২৭ দেশের ইইউ যেন অটুট থাকে।
কী হতে পারে এ বিচ্ছেদের পর? প্রথমত. বুঝতে হবে ইইউর উত্পত্তি ছিল বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র করে মূলত ইউরোপের মধ্যকার বাণিজ্যে নানা বাধা থেকে নিজেদের মুক্ত করা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৫১ সালে ছয়টি দেশ প্রথম ইসিএসসি (ইউরোপিয়ান কোল অ্যান্ড স্টিল কমিউনিটি) সৃষ্টির চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। তখন তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, কয়লা ও স্টিল বাণিজ্যের আন্তঃদেশীয় বাধা দূর করা। জার্মানি ও ফ্রান্স তখন ইউরোপে এ দুই পণ্যের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯৫৭ সালে রোমে প্রতিষ্ঠিত হয় ইইসি (ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি) ও ইউরেটম (ইউরোপিয়ান অ্যাটমিক এনার্জি কমিউনিটি)। একটির লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য আর অন্যটির লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক জ্বালানি বিষয়ে সুরক্ষা, গবেষণা ও আবিষ্কার। ১৯৫৯ সালে ইউরোপের সাতটি দেশ— অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, নরওয়ে, পর্তুগাল, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য তৈরি করে ইউরোপীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকা বা ইএফটিএ। ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্য ইইসির সদস্যপদ গ্রহণের আবেদন করে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দ্য গল তখন যুক্তরাজ্যের সদস্যপদ গ্রহণের সদিচ্ছার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালে তিনটি ইউরোপীয় জোট যথা— ইসিএসসি, ইইসি ও ইউরেটম একীভূত হয়ে ইইউ প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৭ সালে ব্রাসেলসে আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউ প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিকে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ইএফটিএ তাদের অবস্থান ক্রমে বাড়াতে থাকে। তবে দেখা যায় যে, ইএফটিএর বেশকিছু দেশ যেমন— অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সুইডেন ও যুক্তরাজ্য ক্রমে ইইউর সদস্যপদ গ্রহণ করে। নরওয়ে রাজি থাকলেও গণভোটের মাধ্যমে তারা ইইউর সদস্যপদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় ১৯৭২ সালে। অন্যদিকে ১৯৭৫ সালে ব্রিটেন গণভোটের মাধ্যমে ইইউর সদস্যপদ গ্রহণ বহাল রাখে। ১৯৮৪ সালে ইইউ চুক্তির মাধ্যমে বর্তমান ইইউর প্রতিষ্ঠা হয়। এর পর আরো অনেক কিছু হয়েছে, ইউরো জোন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবাই একসঙ্গে থাকেনি। কি হয়েছে তাতে? এত কিছু বলার উদ্দেশ্য, কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করা। এক. ইইউর পক্ষে-বিপক্ষের খেলা আজকের নতুন বিষয় নয়। দুই. এত সব পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের বড় কোনো ক্ষতি হয়নি।
তা সত্ত্বেও কেন চীনসহ প্রায় সব দেশ কিছুটা হলেও চিন্তিত? এ প্রশ্নের জবাব মিলবে আরো একটি বিশ্লেষণে। বর্তমান বিশ্বে কয়েক ধরনের দেশ রয়েছে। এক. মুক্ত বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে জোটবদ্ধ দেশ, যেমন— নাফটা (মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সমন্বয়ে), ইএফটিএ (যাতে রয়েছে নরওয়ে, আইসল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড)। আর এখন রয়েছে তুরস্ক, সৌদি আরব, গালফভুক্ত দেশগুলো, মিসর, মরক্কো, তিউনিসিয়া। এপেক দেশগুলো, মারাখেশ দেশগুলো, পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো প্রভৃতি জোট। সবার লক্ষ্য একটি— বাণিজ্য উদারীকরণ। দুই ডব্লিউটিও অন্তর্ভুক্ত ১৬২টি দেশ। তিন. মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো যেমন— ইইউ এবং আসিয়ান দেশ। বাকিরা চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে। অনেকেই তাই ডব্লিউটিওর সদস্যপদ গ্রহণে উত্সুক। বুঝতেই পারছেন, যদি কোনো দেশ বাণিজ্যিক জোটের বাইরে থেকে যায়, তার জন্য বিপদ অনেক। পদে পদে তাকে বিশ্ব বাণিজ্যে বাধার সম্মুখীন হতে হবে। এমতাবস্থায় যুক্তরাজ্য মুক্ত অর্থনৈতিক জোট অর্থাত্ ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে কোথায় দাঁড়াবে? আপাতত তার শেষ আশ্রয়স্থল হবে ডব্লিউটিও। তবে আমার ধারণা, তারা ইএফটিএ অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে অতি সহজেই। ফলাফল কি দাঁড়াবে। প্রথমত. বাণিজ্যিকভাবে তারা ইউরোপের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে, তবে অর্থনৈতিকভাবে বেশকিছু বাধার সম্মুখীন হবে। বিশ্ববাণিজ্যের ধারা দেখলে বোঝা যাবে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানিগুলো বেশকিছু পণ্য ও সেবা বাণিজ্যে ইইউর শুল্ক বাধায় আটকে যাবে। তবে এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের ডব্লিউটিও সদস্যপদ তাকে কিছুটা শক্তি দেবে। ইইউ বৈশ্বিক বাণিজ্যে এককভাবে কিছু করতে পারবে না। একই সঙ্গে এটুকুও বুঝতে হবে, মুক্ত বাণিজ্যিক ব্যবস্থা আর মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এক নয়। ডব্লিউটিও ব্রিটেনকে বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় বাধা দূর করতে সাহায্য করবে। ব্রিটেনের জন্য অশুল্ক বাধা তেমন প্রকট হবে না। তবে পণ্য বাণিজ্য, সেবা বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বাণিজ্য এক নয়। বিনিয়োগ বাণিজ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন বাধার মুখে পড়বে। আর এ জন্যই নরওয়ে (যারা ১৯৭২ সালে একইভাবে সদস্যপদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, তারা বার বার সতর্কবার্তায় বলছিল, ব্রেক্সিট যেন না হয়)। যুক্তরাজ্যের সেবা খাত অনেক বেশি সংগঠিত, বৈশ্বিক ও নিয়মানুগ। তাই আমার ধারণা, সেবা খাতেও তেমন কোনো প্রভাব শেষ পর্যন্ত পড়বে না। যেমন আমরা জানি যে, ব্যাংকিং কিংবা ইন্স্যুরেন্স কিংবা অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ডসে যুক্তরাজ্য সবসময়ই বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় বলে রাখা ভালো, যুক্তরাজ্য সবর্দাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাণিজ্য করে এসেছে, আগামীতে যুক্তরাষ্ট্র তার কিছুটা হলেও বৃদ্ধি করবে। যদিও খুব তাড়াতাড়ি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত নাও হতে পারে।
মনে করতে পারেন বাংলাদেশের কি হবে? আমার ধারণা, বড় ধরনের কিছু হবে না। আপাতত পাউন্ডের দরপতনে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য (যত দিন যাবত্ বিষয়টি সুরাহা হবে না) আমাদের যুক্তরাজ্য অভিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিছুটা হলেও সিলেটের অর্থনীতি। কারণ সেখানকার আর্থিক কর্মকাণ্ড যুক্তরাজ্য থেকে প্রেরিত পাউন্ডের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্রিটিশ সাহায্যপুষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। যাদের অনেকেই এরই মধ্যে ১০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ হারিয়েছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে আমাদের তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা নেই। কারণ প্রধানত দুটি। এক. ডব্লিউটিওর আওতায় আমাদের প্রতি নতুন কোনো বিরূপ আচরণ ব্রিটেন করবে না। দুই. ব্রিটেন এখন কমনওয়েলথ সম্পর্ককেই জোরদার করবে বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ লাভবানই হতে পারে। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো বিনিয়োগের জন্য ইউরোপের বাইরে বাজার খুঁজতে থাকবে আর সেক্ষেত্রে বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি সম্ভাব্য গন্তব্য। সর্বশেষ আমাদের সরকারের উচিত, দুটি বিষয়েই সজাগ থাকা এবং প্রয়োজনীয় নিজস্ব বিশ্লেষণ তৈরি রাখা, যাতে আমরা নতুন এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারি। সুযোগ হলে কমনওয়েলথভিত্তিক মুক্ত বাণিজ্য এলাকা তৈরি করতে ব্রিটেনকে উত্সাহিত করা বা তাদের প্রস্তাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা; পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট
পাঠকের মতামত