সম্পাদকীয়
২০১৭ সালের অর্থনৈতিক ভাবনা
বছর শেষ। কেমন গেল বছরটি? কিংবা কেমন যাবে নতুন বছরটি? এই প্রশ্ন সবার মনে। আমি যদি গণক হতাম, তবে হয়তবা চোখ বন্ধ করে বলতাম নতুন বছরটি বাংলাদেশের জন্য হবে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। কারণ আমি গণক নই। আমার কাছে নেই কোনো ম্যাজিক কাঠি, যার বদৌলতে আমি বুঝতে পারব কেমন হবে আগামী দিন আমার কিংবা আমাদের দেশের জন্য। অর্থনীতিবিদদের এ-জাতীয় ভবিষ্যদ্বাণী সাধারণত সত্য হয় না। কারণ মানুষ প্রতিনিয়ত তার আচরণ পরিবর্তন করতে থাকে। এ পরিবর্তিত অবস্থায় আগের কোনো আগাম ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক থাকে না। এ কারণেই অর্থনীতিবিদের কাছে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী আশা করা যায় না। তবে কি আমি বছরটির সালপূর্তির দলিল রচনা করব? যেখানে লেখা থাকবে গত বছর এই এই ঘটনা ঘটেছিল। আসলে অর্থনীতিবিদের কাছে এর কোনো কিছুই আশা করা যায় না। কারণ আমরা ইতিহাসবেত্তা নই। ইতিহাস লেখা আমাদের কাজ নয়। আমাদের কাজ চলতি ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে আগামীর জন্য দেশ ও দেশের অর্থনীতিকে প্রস্তুত রাখা, যাতে অঘটন না ঘটে।
যাহোক, ২০১৬ সালটি কেমন গেল সে প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। কারণ আমরা তা সবাই জানি বা দেখেছি। আমাদের অভিজ্ঞতায় গত বছরটি ভালোই ছিল। বেতন বেড়েছে। পেনশনের টাকা বেড়েছে। কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। জাতীয় উৎপাদন বেড়েছে। আমরা এখন বুকে হাত রেখে বলতে পারি, আমরা একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। অনেকটা ‘সি মাইনাস’ গ্রেডের মতো। ‘সি’ নয় আবার ‘ডি’ও নয়। আমরা ‘ডি’ গ্রেডের উপরে উঠেছি। তাই এখন ‘বি’ গ্রেডে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারি। বিষয়টি নিয়ে নিন্দুকরা অনেক কথাই বলতে পারেন, তবে বাংলাদেশের জন্য তা একটি বড় অর্জন। শুধু তা-ই নয়, ২০১৬ সালে আমরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে দৌড়াতে শুরু করেছি। বিশ্বব্যাংকের দেয়া দুর্গন্ধ (দুর্নীতি) দূর হয়েছে। স্বয়ং বিশ্বব্যাংকই এখন উদগ্রীব কীভাবে বাংলাদেশকে আরো অর্থ দেয়া যায়। পদ্মা সেতুতে দেয়া গেল না, ভুল হয়ে গেছে! এখন তারা অর্থের ঝুলি নিয়ে ছুটে এসেছেন। জলবায়ুর প্রভাব থেকে আমাদের দরিদ্র জনগণকে রক্ষা করতে তারা এখন সব সাহায্য দিতে প্রস্তুত! তবে এই সাহায্য দান নয় ঋণ। আমাদের সরকারকে তা ফেরত দিতে হবে সুদসহ। কেন? বিষয়টি এখনো বোধগম্য নয়।
আমাদের ধারণা ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলো সাহায্য দেবে। অন্তত প্যারিস সম্মেলনে তা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা নয়, সাহায্য দিতে অতি ইচ্ছুক বিশ্বব্যাংক। আমাদের দুর্নীতি এখন কোনো বিষয়ই নয়। বলা বাহুল্য, বিশ্বব্যাংক এর আগে একবার চীনকে দুর্নীতিবাজ দেশ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছিল, দুর্নীতি দূর না হলে তারা সাহায্য বন্ধ করে দেবে। চীন সরকার উত্তরে বলেছিল, দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, একা চীনের নয় আর চীন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তা দূর করতে। এ প্রসঙ্গে তারা বিশ্বব্যাংকের খবরদারি বা উপদেশকে যৌক্তিক মনে করে না আর তাই তারা আর বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেবে না। শিগগিরই তখন বিশ্বব্যাংক বুঝেছিল, চীনের এ পদক্ষেপের ফলে তাদের প্রায় অর্ধেক লোকবল ছাঁটাই করতে হবে। কারণ চীন একটি বৃহত্ ঋণগ্রহীতা। ফলে বিশ্বব্যাংক তাদের সব শর্ত বাতিল করেছিল। বুঝতেই পারছেন, কে দুর্নীতিগ্রস্ত!
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর একটি অন্যতম ঘটনা। শি জিনপিং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির প্রধান। ১০ বছরের মাথায় তার দুবার বাংলাদেশ সফর বিশ্বের অনেক সরকারকে চিন্তায় ফেলবে। কারণ? কী আছে এই দেশে যে, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির প্রধান মাত্র ১০ বছরের মাথায় দ্বিতীয়বার এই দেশে এলেন? বলা বাহুল্য, ২০০৭ সালে তার সফর ছিল সম্ভবত চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। তার এ সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত সবাই যে বেশ নড়েচড়ে বসবে, তা বলা বাহুল্য। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী এমন রস রয়েছে যে, চীন এতটা উদগ্রীব! বিস্ময় সবার। বিস্মিত এ দেশগুলো বসে নেই। তাদের চাল চলছে। সম্প্রতি কলকাতায় দক্ষিণ এশিয়ার মার্কিন দূতদের একটি বৈঠক হয়েছে। তাদের সঙ্গে ছিলেন অনেকে, আলোচনার মুখ্য প্রতিপাদ্য ছিল কী করে বাংলাদেশে বিনিয়োগ সমীকরণে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত জোটবদ্ধভাবে চীনের মোকাবেলা করবে। বাংলাদেশের জন্য তা আশার কথা। কারণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা এখন একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার। সবাই চায় আমাদের কী করে সাহায্য করা যায়। স্পষ্টতই বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাওয়ায় এখন অনেকেই মনে করে যে, বাংলাদেশ একটি নির্ভরযোগ্য দেশ যেখানে বিনিয়োগ সম্ভব। প্রশ্ন হবে, আমরা কী করে এই প্রতিযোগিতার সুফল ঘরে তুলব? আমরা কি পারব সুইজারল্যান্ডের মতো নিরপেক্ষ কিন্তু নির্ভরযোগ্য থাকতে?
২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অধিষ্ঠিত হবেন। তার ক্ষমতারোহণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কি কোনো প্রভাব পড়বে? ২০১৭ সালে ব্রিটেন ব্রেক্সিটের সুতো গুটাতে শুরু করবে, তার কি কোনো প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়বে? এসব প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। কারণ প্রতিনিয়ত দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়। ট্রাম্প স্পষ্টতই চাইবে তার দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে। নির্বাচনের ফলে সাধারণত অর্থনীতি এমনিতেই কিছুটা চাঙ্গা হয়, তবে তার মূল লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের দিকে চাকরির বাজার ঘুরিয়ে নেয়া। কী ধরনের চাকরি? তা ট্রাম্প স্পষ্ট করেননি। যদি মনে করেন, তিনি তার দেশে গার্মেন্টস শিল্পকে আমেরিকামুখী করতে চান, তবে তার সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ এত স্বল্প বেতনের চাকরি মার্কিনিরা করবে না বলেই তা একদিন বাংলাদেশ কিংবা চীনের মতো দেশে চলে এসেছে। কে না জানে যে, একদিন কাপড় উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ডান্ডি। কিন্তু তা এখন নেই। হবেও না। তাই আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের জন্য ট্রাম্প নতুন কোনো শঙ্কা নয়। তবে কি ট্রাম্প সব কল সেন্টার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত নেবেন? আমার ধারণায় তাও সম্ভব হবে না (তবে লোক দেখানো কিছু চমক থাকতে পারে)। কারণ কল সেন্টারের সার্ভিস ভোগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন শিল্প ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এই কাজ যুক্তরাষ্ট্রে ফেরানোর অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সেবা ও শিল্প খাত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক সুবিধা হারাবে। এমনিতেই চিকিত্সার জন্য খোদ মার্কিনিরা ছুটে আসছেন এশিয়ায় (ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ)। তাই এ খাতের চাকরি ফেরত নিলে গোটা মার্কিন অর্থনীতিই তার বাজার সুবিধা হারাবে। তবে হ্যাঁ, বিদেশে মার্কিন কোম্পানির বিনিয়োগ সাময়িকভাবে কমে যাবে আগামী বছরে। ট্রাম্প তার দেশে বিনিয়োগ উত্সাহিত করার জন্য বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করবেন। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা কিংবা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। বাংলাদেশের ওপর এর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ আমাদের বিনিয়োগ কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে খুব কমই আসে। তবে বিনিয়োগের আড়ালে নতুন চাকরির বাজারে বাংলাদেশীসহ বহু এশীয় বিজ্ঞানী (যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষায় রত) সুবিধা পাবেন। ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট স্লোগানের ফলে বাংলাদেশের মূল অর্থনীতিতে মারাত্মক কিছু হবে না।
তবে কি ব্রেক্সিটের প্রভাবে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে? কিছুটা হতে পারে, তবে তা ঠিক ব্রেক্সিটের জন্য নয়। হবে ট্রানজিশনের জন্য। প্রশ্ন হলো, ব্রেক্সিটের কোন পর্যায়ে যুক্তরাজ্য তার নিয়ম পাল্টাবে? আমরা জানি, ব্রেক্সিট শুরু হবে মার্চ থেকে। বাংলাদেশের জন্য ব্রিটেনের নতুন নিয়ম কি মার্চ হতেই চালু হবে? নাকি বাংলাদেশের জন্য প্রদত্ত ইইউ বাণিজ্য সুবিধা ব্রেক্সিট শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের বাজারে চালু থাকবে? বিষয়টি এ পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। আমি ধরে নিচ্ছি, বাংলাদেশের জন্য প্রদত্ত বাণিজ্য সুবিধা ২০১৭ সালে অন্তত বহাল থাকবে। এক্ষেত্রে ব্রেক্সিটের প্রভাব আমাদের জন্য প্রকট হবে না।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবা প্রয়োজন। ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি পরিসংখ্যানে (২০১৫ সালে প্রকাশিত) দেখা গেছে, ২০১০-১৩ সালে আমাদের দেশে যে মোট ৪৬ লাখ নতুন শ্রমিক বাজারে প্রবেশ করেছেন। বাংলাদেশে যেখানে গড়ে প্রতি বছর ১০ লাখ চাকরি তৈরি হয়, সেখানে এই সময়ে তা হয়েছে মাত্র ১৩ লাখ। তবে শ্রমবাজারে পুরুষ ও নারী দুই ধরনের শ্রমিকের হার কমেছে। পুরুষদের ৮১ শতাংশ এখন চাকরিরত, যা ২০০৫ সালে ছিল ৮৬ শতাংশ আর নারীদের ৩৩ শতাংশ, যা ২০০৫ সালে ছিল ২৯ শতাংশ (তবে ২০১০ সালে ছিল ৩৬ শতাংশ)। কেন শ্রমবাজার থেকে পুরুষ ও নারী শ্রমিকের হার কমে গেল, তা ভেবে দেখার বিষয়। তারা কি ঘরে বসে দেশে বা বিদেশের বাজার শ্রম বিক্রয় করছেন? প্রায় লক্ষাধিক যুবক এখন ওডেস্ক জাতীয় ওয়েব পোর্টাল ব্যবহার করে বিদেশে শ্রম বিক্রি করছেন। তাদের কী করে শ্রম পরিসংখ্যানে আনা যায়, তা দেখতে হবে। শ্রম পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ৮৬ শতাংশ শ্রমিক অসংগঠিত খাতে নিয়োজিত। তারা কেউ আছেন শিল্প-কারখানায়, কেউ রয়েছেন সেবা খাতে বাকিরা কৃষিতে।
শুধু তা-ই নয়, এসএসসি বা এইচএসসি পাস করে বেকার বসে আছেন মোট বেকারের প্রায় ৫৬ শতাংশ। অর্থাত্ দেশের স্কুল শেষ করে বেকার হয়ে আছেন মোট বেকারের অর্ধেকেরও বেশি লোক। শিক্ষিত এই যুবগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় স্বাভাবিক শিক্ষার আগ্রহ কমবে। তাদের জন্য প্রয়োজন অকৃষি খাতে কর্মসৃষ্টি করা। এর মধ্যে আছে শিল্প ও সেবা খাত। দেশের এ দুই খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পেলে তা রাজনীতি ও অর্থনীতি দুইয়ের জন্যই বিপদ ডেকে আনতে পারে।
সেদিন আমার এক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার কাছে জানলাম, তার এক ভাই বিদেশে যেতে মরিয়া। তারা যতই বোঝাচ্ছেন যে, বিদেশে যাওয়া অত সহজ নয়, নানা বিপদ হতে পারে। তাতেও সে নাছোড়বান্দা। কারণ? তার কাজ নেই। বিদেশে এখন নারীদের কাজ বাড়ছে। কিন্তু কী কাজ, কেউ জানে না। আমার পরিচিত এক নারী কিছুদিন আগে গেল সৌদি আরবে। যাওয়ার আগে তাকেও না করেছিলাম কিন্তু শোনেনি। তিন মাস পর দেশে ফিরেছে। বেতন পায়নি। অমানুষিক পরিশ্রম করেছে। শেষ পর্যন্ত পালিয়ে বেড়িয়েছে। এক বাংলাদেশীর সাহায্যে গিয়েছিল সৌদিতে বাংলাদেশের দূতাবাসে। সেখান থেকে জেলে। জেলে তার মতে শত শত নারী, ফেরত আসার টিকিট নেই। তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। দূতাবাসের এক কর্মকর্তার দয়ায় দেশে ফেরত এসেছে। এখন বেকার এবং অসুস্থ। দেশে বেকারত্বের অভিশাপ হতে মুক্তি পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় ২৬ লাখ। এর মধ্যে ১৮ লাখের বয়স ১৫-৩০ বছর। তাদের সঙ্গে প্রতি বছর যোগ দিচ্ছে প্রায় নয় লাখ নতুন মুখ। তারা প্রতি বছর শ্রমবাজারে যুক্ত হয়। তারাও খুঁজতে থাকবে কাজ।
তাই ২০১৭ সালে সরকারের প্রধান কাজ হবে, কী করে দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যায় তার ব্যবস্থা করা। অনবরত ভাতা বৃদ্ধি করে কিছু লোককে শান্ত করা যাবে বটে, তবে প্রতি বছর যে পরিমাণ নতুন শ্রমিক বাজারে আসে, তাতে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ কর্ম সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ। তবে তা হতে হবে সেই বিনিয়োগ, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। প্রচলিত নিয়মে এ কাজ সহজ হবে না। কারণ গত ২০ বছরের পরিসংখ্যান লক্ষ করলে দেখা যায়, আমরা দেশে বছরে প্রায় ১০ লাখের মতো নতুন চাকরি সৃষ্টি করতে পারি। আরো অতিরিক্ত ১০ লাখের কর্মসংস্থান কিন্তু একই নিয়মে হবে না। প্রয়োজন হবে নতুন চিন্তার, নতুন ব্যবস্থার। তদুপরি বিদেশে লোক পাঠানো প্রতিনিয়ত কঠিন হবে। অদক্ষদের চাহিদা কমবে, তবে শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা থাকবে বিশ্বব্যাপী।
এসব নিয়ে ভাবার জন্য সংক্ষেপে আমার অভিমত দিচ্ছি। প্রথমত. শিক্ষা ব্যবস্থাকে বৈশ্বিক করতে হবে, যেখানে দেশের গ্র্যাজুয়েট বিদেশেও সমান তালে শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে। বর্তমান সরকার এই লক্ষ্যে ২০১৪ একটি বিধিমালাও চালু করেছে। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা দেশে চালু করা। ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি চীনও তা চালু করেছে। এতে দেশে শিক্ষা নিয়ে বিদেশেও চাকরি পেতে কোনো বেগ পেতে হবে না। বিধি বলবত্ কিন্তু আটকে আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। চালু হতে দিচ্ছে না। দ্বিতীয়ত. ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বিমানবন্দর বিদেশী বিমানবহরের হাব হিসেবে চালুর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ইউরোপের বহু বিমান সংস্থা ভারত ও চীনের বাজারে ঢুকতে চাইছে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য। কিন্তু তা সম্পন্ন করতে তাদের প্রয়োজন এশিয়ায় একটি হাব। ভারত দেবে না। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর দেবে না। সবাই চাইছে নিজেদের বিমানবহরগুলোকে প্রণোদনা দিতে। তাই বাংলাদেশ একটি আদর্শ স্থান। তিনটি বিমানন্দর তিনটি এয়ারলাইনসের জন্য হাব হিসেবে ব্যবহারের অনুমোদন দিলে এ-সম্পর্কিত বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস করবে। বিনা বিনিয়োগে দেশে তৈরি হবে নতুন সুপরিসর বিমানবন্দর। তাতে বাংলাদেশ এশিয়ার একটি অন্যতম যাতায়াতস্থল হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ ব্যবস্থা সম্পন্ন হলে পরবর্তীতে দেশে আসবে নতুন সেবা খাত। বিশ্বের সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে ব্যবহার করবে তাদের সেবাবিন্দু হিসেবে। বাংলাদশ হবে প্রাচ্যের নতুন সিঙ্গাপুর। ছোট দেশ তবে তার মূল কাজই হবে ভারত ও চীনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক খাতে সেবা প্রদান। বিশ্বের প্রধান দুই অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের এই নতুন যোগসূত্র হবে যুগান্তকারী। তবে প্রয়োজন হবে আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার। ফলে শিক্ষিত বেকার হ্রাস পাবে। তদুপরি বিদেশী ডিগ্রি দেশে পাওয়া গেলে তারা ভারত কিংবা অন্য দেশ হতে শিক্ষিত শ্রমিক আনবে না। তৃতীয়ত. শিল্পায়নে আউটসোর্সিং একটি পরিচিত নাম। আমাদের গার্মেন্টস খাত মূলত আউটসোর্সিং নির্ভর। এখন প্রয়োজন নতুন নতুন শিল্পকে এতে যুক্ত করা। এর জন্য প্রয়োজন হবে নতুন আর্থিক ও বাজার ব্যবস্থা, যাতে আমাদের কারখানাগুলো যুক্ত হবে আন্তর্জাতিক শিল্পের সঙ্গে। তারা তৈরি করবে অন্য দেশের শিল্পের উপকরণ। সব ব্যবস্থাই আমাদের হাতে মুঠায়। কর্মসৃষ্টির এই নতুন পথ তৈরি করা সম্ভব আর তা করতে সরকারকে হতে হবে কৌশলী এবং সৃষ্টিশীল। প্রয়োজন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন, যাদের কাজ হবে গবেষণালব্ধ জ্ঞান হতে সরকারকে অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করা এবং প্রয়োজনীয় বাস্তবসম্মত উপদেশ প্রদান করা।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট
পাঠকের মতামত