সম্পাদকীয়
স্বেচ্ছাশ্রমের অর্থনীতি ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা
কথা হচ্ছিল ছেলের সঙ্গে। আমাদের অনেকেরই এ সুযোগ হয় না। কেন হয় না, তা হয়তোবা সবাই জানি। তবে কিশোর বা যুবক বয়সীদের সঙ্গে কথা সচল রাখা বেশ মুশকিলের। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই। তবে হঠাত্ করেই লক্ষ করলাম, তার মধ্যে বেশ সমাজ সচেতনতা বেড়েছে। বছর তিন আগে সে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, তখন ভাবনা হয়েছিল— পড়াশোনায় সে ভালো হলেও সমাজে তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কতটুকু সচেতন? আজকাল আমাদের মায়েদের ভাবনা প্রচুর। ছেলেমেয়েরা কোথায় যায় তা জানতে হবে। কী করে তাও জানতে হবে। কার সঙ্গে মেশে তাও জানতে চাই। সেই সঙ্গে জানতে চাই, সে কীভাবে যাওয়া-আসা করে? বাস ঠিকমতো থামলে তবেই নামবে বাবা কিংবা পানিটুকুন সঙ্গে নিয়ে বের হও। এমনতর নিত্যদিনের উপদেশ বা আদেশের পর তাদের মাথায় বই কিংবা কোচিং ছাড়া আর কিছু আদৌ যায় কিনা, তা নিয়ে আমরা শিক্ষক-অভিভাবকরা কেন যেন সর্বদাই উদ্বিগ্ন থাকি। কী আছে তাদের মনে? কেউ কি বশ করতে চাইছে? এমনতর ভাবনা আজকাল শুধু মা-বাবা কেন, খোদ সরকারই সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।
যাহোক যা বলছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো, তাকে আমাদের সমাজ থেকে আলাদা করে রাখাটা অন্যায় হচ্ছে। তাদের জানা উচিত তারা কোন দেশের সন্তান। আরো অনুধাবন করা উচিত যে, এ দেশে জন্মেই সে ধন্য হয়েছে। এ বিশ্বাস বইয়ের পাতায় মুখস্থ বাক্যের মতন নয়, অনুধাবন করতে হবে নিজে থেকে। সমাজে যারা পশ্চাত্পদ, তাদের উপকার করা তার একটি প্রাথমিক দায়িত্ব। তাই তাকে ধানমন্ডিতে একটি বেসরকারি সংস্থায় (যার প্রধান ড. কে এ এস মুরশিদ) পথশিশুদের সাপ্তাহিক গণিত শিক্ষা দিতে উত্সাহিত করলাম। আমার ধারণা, এর ফলে বুঝতে পারবে সে কতটা ভাগ্যবান কিংবা পৃথিবীতে কত সহজেই মানুষের উপকার করা সম্ভব। আর উপকার করার ক্ষমতা তার রয়েছে। মায়ের ভাবনা বরাবরই একই রকম— কী করে যাবে ওখানে, কে নিয়ে যাবে তাকে, কে আনবে। মায়ের কাছে সন্তান বড় হয় না— এটা তারই লক্ষণ।
আমার ভাবনার সবটুকু তাকে বলিনি। তবে বুঝিয়েছি যে, কাজটি করলে বেশকিছু গরিব ছাত্রছাত্রীর সক্ষমতা বাড়বে। একসময় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে কিছু না কিছু সামাজিক কাজ করে দেখাতে হতো। তাতে সমাজের উপকার হয়েছে। বিশ্বের বহু দেশে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে যারা সমাজে স্বেচ্ছাশ্রম দেয়, তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এজন্যই ভর্তির ফরমে জানাতে হয় সে পড়াশোনার বাইরে আর কী কী করে। স্বেচ্ছাশ্রম কার্যক্রমে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের অন্তর্ভুক্তি হয়তোবা যুবসমাজকে ঘরে টেনে আনবে। সমাজে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে। তারা প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা তথাকথিত প্রগতিশীলদের খপ্পরে পড়বে না। অথচ আমাদের বর্তমান শিক্ষা কার্যক্রম সবটুকুই পরীক্ষাকেন্দ্রিক। শুধু বইয়ের বিদ্যা যে কোনো সন্তানকে মানুষ করতে পারে না, তা সরকারের শিক্ষা-বিষয়ক মন্ত্রণাদাতাদের মাথায় রয়েছে বলে মনে হয় না।
যাহোক, বছর কয়েক পরই পরিবর্তন লক্ষ করলাম। তার মনে প্রশ্ন এসেছে, যা বই সৃষ্টি করতে পারেনি। আব্বু, ওরা গরিব হলেও বেশ মেধাবী। জানো আব্বু, একটি ছেলে না মুখে মুখে অংক করে ফেলে। আমাকে একটি ছেলে বলেছে, ভাইয়া আমি কখনো বই কিনতে পারিনি, তবে আপনার কাছে পড়ে আমার বই কিনে পড়ার ইচ্ছা হচ্ছে। আচ্ছা আব্বু, আমি কি তাদের দু-একজনকে বই কিনে দিতে পারি? আমরা যে টাকা রিকশার পেছনে ব্যয় করি, তা বাঁচালেই তো অনেকের বইয়ের জোগাড় হয়ে যায়, আজ থেকে আমি হাঁটব। পরিবর্তন এইটুকুনেই সীমিত নয়, তার ক্লাসের আরো কয়েকজনকে সে নিজে থেকে জোগাড় করেছে স্বেচ্ছাশ্রম দেয়ার জন্য। তারাও এখন প্রতি শুক্রবার গরিব শিশুদের গণিত শেখায়। শিশুদের কাছে সপ্তাহে একবারই যায়, তবে তাদের প্রতি এখন তার টান বেড়েছে। আচ্ছা আব্বু, ওদেরকে নিয়ে কি কোথাও যেতে পারি? আমি ভাবছি ওদেরকে নিয়ে বিজ্ঞান জাদুঘরে যাব নাকি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যাব? আচ্ছা, প্লানেটারিয়ামে গেলে কেমন হয়? নিজে নিজেই ভাবল, গিয়ে দেখে আসি কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়। সব স্থানেই গেল। বেরিয়ে এল আসল সত্য। বিজ্ঞান জাদুঘরে খুব বেশি কিছু নেই। ছোট শিশুরা মজা পাবে না। প্লানেটারিয়াম বেশ ব্যয়বহুল। গরিবদের জন্য কোনো ডিসকাউন্ট নেই। আব্বু মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কিন্তু বেশ ইনোভেটিভ! ওরা বলেছে, তারা আমাদের শিশুদের নিয়েও যাবে গাড়ি করে। টিকিট বেশ সস্তা। কী করে সম্ভব? বললাম, ওখানেই যাও। এতগুলো শিশুকে একসঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা যখন রয়েছে, তখন তোমাদের ঝক্কি কমবে। সেই সঙ্গে অর্থনীতির মোক্ষম প্রতিপাদ্য বিষয়টি বুঝতে পারবে। সরকারি উদ্যোগের চেয়ে বেসরকারি উদ্যোগ বেশি দক্ষ। একদিনে ঘটেনি এত কিছু, তিন বছরের সংক্ষিপ্ত সার তুলে ধরলাম। আমার সঙ্গে ছেলের কথোপকথন থামেনি।
তার উত্সাহ ক্রমেই বাড়ছে। এখন সে গণ্ডির বাইরে একটি জগত্ নিয়ে ব্যস্ত। হঠাত্ জানতে পারলাম, তারা স্বেচ্ছাকার্যক্রমের আওতায় গরিব পরিবারকে ইফতারি খাওয়াবে। কোথায় পাবে ইফতারি? আমরা নিজেরা নানা স্থান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ঈদের আগে একদিন ইফতারি খাওয়াব। ঈদে বাড়ি যাওয়ার পালা। তাকে বললাম, তাহলে তো ঈদে বাড়ি যেতে অসুবিধা হবে। কিন্তু না, অবাক হওয়ার আরো বাকি ছিল। বলল, সমস্যা নেই, আমরা সিলেটে গিয়েও ইফতারি খাওয়াতে পারব। কী করে? আমাদের স্বেচ্ছাকার্যক্রম সিলেটেও আছে। বুঝতে পারলাম, তাদের স্বেচ্ছাকার্যক্রম দেশব্যাপী। কারা এরা? এতটা সংগঠিত! উদ্বেগ একটু বেড়ে গেল। যথাসময়ে সিলেটে তাদের স্বেচ্ছাকর্মীরা প্রায় ২৫০ জনের জন্য ইফতারি জোগাড় করল। এবার বিতরণের পালা। তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমও অবাক করে দেয়ার মতো। তাদের ভাষায়, ইফতারি বিতরণের হেডকোয়ার্টার বলে দিয়েছে কে কোথায় যাবে। আমার ছেলেও গেল। ফিরে এলে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন হলো বিতরণ? ভালো, তবে কি জানো আব্বু, আমি একটু অবাক হয়েছি। কেন? তার প্রথম উপলব্ধি— দেশে এত গরিব নেই। কেমন করে মনে হলো? আমাদের বেশ কষ্ট হয়েছে বিনে পয়সার ইফতারি বিতরণে। কেন? অনেকে নিতে চায় না। তবে আমি অবাক হয়েছি অন্য কারণে। কী কারণ? এক বৃদ্ধ মহিলাকে দেখে আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম, আপনার জন্য ইফতারি, নেন। তিনি ইতস্তত করলেন। কেন, আমার জন্য কেন? আমরা সবার জন্য ইফতারি নিয়ে এসেছি, আপনিও নেন। বৃদ্ধার ইতস্তত ভাব গেল না। বললেন, এ খাবারে যে বিষ নেই তা কী করে জানব? বিব্রত অবস্থায় বললাম, আমরা বিষ মেশাতে যাব কেন? নিজেরা প্যাক করেছি, খাবার সংগ্রহ করেছি, যাতে এর গুণাগুণ ভালো হয়। আপনি নিন। সংকোচের সঙ্গে তিনি নিলেন। আমরা আমাদের বিতরণ যখন শেষ করতে যাব তখন আবার সেই বৃদ্ধাকে দেখতে পেলাম। হাতে সেই প্যাকেট। ইফতারি ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন। আব্বু, মহিলা ভিক্ষুক নন, তবে তাকে দেখে মনে হয়েছে তিনি খাবার পেলে উপকৃত হবেন। কিন্তু তার ইতস্তততা দেখে এবং শেষ পর্যন্ত তার ইফতারি ফিরিয়ে দেয়ায় আমি অবাক হয়েছি। বুঝতেই পারছেন, অর্থনীতির হালচাল বদলেছে। এখনো ৭৪-৭৫-র অবস্থাকে দারিদ্র্য মনে করলে ভুল করবেন। হাত পাতা মানুষের সংখ্যা কমেছে। তবে কি গরিবরা ভিক্ষাবৃত্তি থেকে চলে গেছে? ঢাকা শহরে যখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে এত ভিক্ষুক দেখি, তারা আসলে কারা? দরিদ্র নাকি পেশাগত ভিক্ষুক?
গল্প এখানেই শেষ নয়। গত সপ্তাহে আবারো তাদের স্বেচ্ছাশ্রমের তত্পরতা লক্ষ করলাম। এবার তোমাদের কী চিন্তা? কোরবানির ঈদে ইফতারি হবে না, তাই তাদের মাথায় এসেছে এক অদ্ভুত চিন্তা। এবার তারা গরিব শিশুদের হাত-পায়ের নখ কেটে দেবে, সবাইকে হাত ধোয়ার সাবান দেবে আর সেই সঙ্গে মেহেদি পরিয়ে দেবে। তোমাদের ব্যবস্থা কেবল মুসলমানদের উত্সবে কেন? প্রশ্নটা মাথায় এল। তবে জানলাম, তাদের স্বেচ্ছাকর্মীদের মধ্যে সব ধর্মের ছেলেমেয়ে রয়েছে। ঈদ যেহেতু এ দেশের একটি বড় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উত্সব, তাই ঈদে সবার আনন্দের সঙ্গে গরিবদের সম্পৃক্ত করার প্রয়াস তাদের। নখ কাটা ও মেহেদি পরানোর দিন যত ঘনিয়ে এল, তাদের তত্পরতা বাড়ল। আমাদের মনে পড়ে গেল সেই বৃদ্ধার কথা। প্রথমে তাদের সতর্ক করিয়ে দিল ছেলের মা। বললেন, মেহেদিতে কিন্তু মাঝে মধ্যে কেমিক্যাল থাকে, তাতে যদি কোনো অ্যাসিডজাতীয় কিছু থাকে, তবে শিশুদের চামড়ায় প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তোমরা মেহেদি কেনার সময় সাবধানী হবে কিন্তু। বলল, আম্মু আমরা আলমাস থেকে কিনব। ভালো মেহেদি, যাতে এমন বিপদ না হয়। কিন্তু দেখা গেল আলমাস সুপার শপ তাদেরকে যে গ্রিন মেহেদি দিয়েছে, তাও তাদের মতে ‘আসল’ নয়। এখন উপায়? জীবনের প্রথম মেহেদির প্যাকেট হাতে নিয়ে গবেষণায় বসলাম। বললাম, কেন বলছ আসল নয়? তুমি আসল-নকল কীভাবে চেন? তাদের উত্তরে বুঝতে পারলাম, তারা খুঁজছে সবুজ মেহেদি; এটা তা নয়। তাদের মতে, সবুজ মেহেদিতে কেমিক্যাল থাকে না। বললাম, কাল তোমরা দোকানে গিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে এসো। তবে এক কাজ করো, ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখো আলমাসের মেহেদি সম্পর্কে কোনো খারাপ মন্তব্য কেউ দিয়েছে কিনা। যদি না থাকে তবে আমি অতটা চিন্তিত হব না।
পরদিন জিজ্ঞেস করলাম, মেহেদি উত্সবের কী হলো? সফল হয়েছ তো? তা হয়েছে, তবে আব্বু আবারো সমস্যা হয়েছে। কী রকম? আমরা ঝিগাতলা-রায়েরবাজার এলাকায় গিয়েছিলাম মেহেদি দিতে। আমাদের হাতে ছিল ৪০ জনকে দেয়ার আয়োজন কিন্তু আমরা পেয়েছি ৩২ জন। আবারো তাদের মনে হয়েছে, দেশে হয় দারিদ্র্য কমেছে নচেত্ গরিবদের হাত পাতার ইচ্ছা কমেছে। আমার মতে, দ্বিতীয় ধারণাটা সত্য। দেশে প্রতিটি শিশু স্কুলে যায়। এ সফলতা তারই স্বাক্ষর বহন করে। পড়তে গিয়ে তাদের হয়তোবা মনে হয়েছে যে, হাত পাতাটা অবমাননাকর।
গোটা বিষয়টি গল্পের ছলে বললাম কয়েকটি কারণে। প্রথমত. স্বেচ্ছাশ্রম দেশের কিশোর-কিশোরীদের মনে দেশ ও সমাজের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র তৈরিতে সাহায্য করে। সমাজের সঙ্গে তাদের দায়বদ্ধতা তৈরি করে। শিক্ষা পাঠক্রমে তাই স্বেচ্ছাশ্রম কার্যক্রম থাকা উচিত। দ্বিতীয়ত. গঠনমূলক স্বেচ্ছাকার্যক্রম চালু হলে যুবসমাজের মনোভাব সমাজবিমুখ হবে না। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, নতুন শিক্ষানীতির আওতায় এসব সামাজিক কার্যক্রমকে উত্সাহিত না করে বরং বছর বছর পরীক্ষা কার্যক্রমকে জোরদার করা হয়েছে। তাতে আমাদের শিশুরা না পারছে গানবাজনা, খেলাধুলায় যোগ দিতে, না পারছে বইয়ের বাইরের কিছু নিয়ে চিন্তা করতে। ফলে আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যাদের পাব, তাদের অধিকাংশই হবে মুখস্থ বিদ্যার পাহাড়। বিষয়টি কি শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় ভাববেন?
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট
পাঠকের মতামত