বিশেষ সংখ্যা/বাংলা - দক্ষিণাঞ্চল
সমৃদ্ধির আধার থেকে ত্রাণ বিতরণের অর্থনীতি
একসময় দক্ষিণাঞ্চল ছিল দেশের সমৃদ্ধির আধার। একদা বরিশাল ছিল ধন আর ধানের অঞ্চল; ছিল ক্ষমতার প্রতীক। দক্ষিণাঞ্চলের রাজনীতিবিদ ফজলুল হক একসময় কাঁপিয়েছেন দুই বাংলা। তাই তার নাম হয়েছিল শেরেবাংলা। শিক্ষায় বরিশালের সঙ্গে পারা যেত না। উপকূলীয় দ্বীপ সন্দ্বীপের সন্তান কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কলকাতায় তার নামে এখনো একটি সড়ক রয়েছে। স্বয়ং গান্ধীজি উপকূলীয় জেলা নোয়াখালীতে এসেছিলেন। কিন্তু তারপর? তারপর কী হলো? বছর দশেক আগে স্যার পার্থ দাশগুপ্ত এসেছিলেন বাংলাদেশে আমারই আমন্ত্রণে। তার বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। পার্থ দাশগুপ্ত বললেন, তার গ্রাম দেখবেন। শেষ পর্যন্ত বুঝলাম, তারও বাড়ি বরিশালের আগৈলঝরায়। তাকে তার গ্রাম দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই উপকূলের জেলাগুলোর অবস্থা ক্রমেই সঙ্গিন হচ্ছে। বরিশালের মোট জনসংখ্যা ক্রমাগত কমছে। মানুষ পাড়ি দিচ্ছে অন্য এলাকা বা ঢাকায়।
খুলনার বেশকিছু উপজেলায়ও একই অবস্থা। কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম চালনায়। চালনার নাম অনেকেই জানেন। মংলার আগে চালনাই ছিল আমাদের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর। চালনার বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত করুণ। মনে হবে, এক শতাব্দী আগের কোনো শহরে প্রবেশ করছেন। জীবন্ত জাদুঘর!
২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতের এক বছর পর গিয়েছিলাম খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চল কয়রা ও শ্যামনগর এলাকায়। হঠাৎ করেই লক্ষ করলাম রাস্তায় পানি। কপোতাক্ষ নদের পানি। উপচে পড়ছে। শীতকালে নদীর পানি উপচে পড়ছে দেখে আচমকা বোকা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরে জানলাম কপোতাক্ষ মরে গেছে। নদীর তলদেশ পলি পড়ে উপরে উঠে গেছে। তাই পানি নামছে না। উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগের হাতছানি সর্বদাই ছিল এবং আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব অঞ্চলে দুর্যোগ আরো বাড়বে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন হবে বলে মনে করি। এ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এ লেখা।
বরগুনা কিংবা পটুয়াখালীতে আপনারা অনেকেই ভ্রমণ করেছেন। প্রায় ১০ বছর আগে ২০০৮ সালের অক্টোবরে গিয়েছিলাম বরগুনায়। আমাদের লক্ষ্য বুঝতে চেষ্টা করা যে, ২০০৭ সালে সিডরের পর যেসব ত্রাণ এসেছে, তার সঠিক ব্যবহার হয়েছে কিনা। ঢাকা থেকে লঞ্চে করে গেলাম বরিশালে। সেখান থেকে গাড়িতে বরগুনায়। শহরের এক প্রান্তে একটি বেসরকারি সংস্থার রেস্ট হাউজে অবস্থান করছিলাম আমরা কয়েকজন। আগেই বলেছি, আমাদের লক্ষ্য ছিল ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর ত্রাাণ বিতরণের অবস্থা সম্পর্কে মূল্যায়ন করা। পরদিন সকালে আমাদের দল গেল পায়রা আর বলেশ্বর নদীর মোহনায়। দেখার মতন একটি স্থান। বিশাল দুই নদী মিলিত হয়ে সাগরে পড়েছে। আমাদের উত্সাহ বেড়ে গেল। দুপুরবেলা নদীর এপারে খাবারের কোনো ব্যবস্থা দেখতে পেলাম না। আমরা ভাবলাম ওপারে যাই। ওপার মানে পাথরঘাটায়। ছোট কিন্তু পরিপাটি একটি শহর। একটি খেয়া নৌকায় পার হয়ে গেলাম বিশাল এই নদী। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ সবাইকে অপার আনন্দ দিচ্ছিল। দূরে মানুষের তৈরি একমাত্র সুন্দরবনের একাংশ দেখা যাচ্ছে। ওটা আসল সুন্দরবন নয়। পাথরঘাটায় একটি ছোট খাবারের দোকানে আমরা বেশ তৃপ্তির সঙ্গেই খেলাম। শহর দেখার উত্সাহ থাকায় রিকশায় কিছুটা ঘুরেও দেখলাম। বুঝতে পেলাম ঘূর্ণিঝড়ে এদের আশ্রয়স্থল বেশ জরুরি। তবে লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম যে, ঘূর্ণিঝড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনেকের অনীহা আছে। প্রধান কারণ বাড়ির সম্পদ রক্ষা। বিশেষ করে গরু-ছাগল এমনকি কুকুরের মায়ায়ও অনেকেই যেতে চান না। মনে পড়ে গেল আমার এক চাচির কথা। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। আমাকে খুব আদর করতেন। দিনে একবার চাচির বাসায় না গেলে আমার যেন পেটের খাবার হজমই হতো না। তার বাসায় ছিল গালগল্পের আড্ডাখানা। আর ছিল সুস্বাদু খাবার। আমি যাব জেনেই কিছু না কিছু বানিয়ে রাখতেন। একদিন গিয়ে দেখি তিনি অঝোরে কাঁদছেন। আমি ও আমার এক বন্ধু দুজনেই গিয়েছি একই সঙ্গে। চাচির কান্নায় কিছুটা হতভম্ব। কী হয়েছে? কাজের মেয়ে জানাল, চাচির পোষা মুরগিটা মারা গেছে। কতটুকু মায়ামমতা থাকায় তার এতটা দুঃখ, তা হয়তো অনেকেই ভাবতে পারবেন না।
১৯৭১ সালের ১৪ বা ১৫ ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় কিন্তু সিলেট শহরে তখনো যুদ্ধ চলছে। আমরা থাকতাম সরকারি বাসায়। কিন্তু বাড়িটির দেয়াল ছিল বাংলো টাইপের। বাঁশের ওপর সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে তৈরি। তখন সিলেটের সুরমা নদীর দক্ষিণ পার মুক্তিবাহিনীর দখলে। সারা দিন ভারতের বোমারু বিমান আকাশে উড়ছে আর থেকে থেকে বোমা মারছে। রকেট আর মর্টার শেল যাচ্ছে আমাদের বাসার ওপর দিয়ে। কারণ আমাদের পেছনেই ছিল পাকিস্তান বাহিনীর একটি ক্যাম্প। রাতে কনকনে শীতে আমরা মাটির নিচে বাস করছি। অবস্থা ক্রমাগত কঠিন হচ্ছে। দুই পক্ষই মর্টার আর কামানের গোলা নিক্ষেপ করছিল আর তা আমাদের মাথার ওপর দিয়ে প্রায় ৫০০ মিটার পেছনে পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্পের আশপাশে পড়ছে। সকালে আব্বা বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর এসে বললেন, এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। জিনিসপত্র বিশেষত কাপড় ও খাবার গুছিয়ে নিয়ে চলো আমরা পেছনে কৃষি কলোনিতে আশ্রয় নিই। কেন? ওখানে একটি বাসা দেখে এসেছি। ছাদটা ঢালাই করা। দেয়াল ১০ ইঞ্চি। তাই ওখানে থাকাটা নিরাপদ হবে। রাতে ট্র্যাঞ্চে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। তোমাদের সবার অসুখ হবে। দুটো রিকশা, আরেকটি ঠেলা নিয়ে আমরা নির্বিঘ্নে পার হয়ে গেলাম কৃষি কলোনিতে। সঙ্গে নিয়ে গেলাম আমার দুটো ছাগলও। পশুপালনে আমার বরাবরই শখ ছিল। ছাগলগুলো আমার বেশ শখের। আমার কথা শুনত। তবে মাঝে মধ্যে আমাদের বিছানায় বসে পড়ত। যাহোক, ওখানে গিয়ে দেখলাম, আমরা আসলে পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্পের ১০০ গজের মধ্যে এসেছি। প্রতিটি মর্টার শেল বাসার পেছনের ডোবায় পড়ছে। ওই বয়সে ভয়ভীতি কম ছিল। আমরা বাসার ভেতরে থেকে মর্টারের শব্দ শুনে আন্দাজ করতাম কোথায় পড়তে পারে। হঠাৎ করেই বাইরে শোরগোলের শব্দ পেলাম। বের হয়ে দেখি, লোকজন আমাকেই খুঁজছে। সঙ্গে পাকিস্তানি দুই পাঠান সিপাই (ক্যাম্পটি ছিল পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনীর)। তাদের দেখে ভয় পেলাম। তার পরই দেখলাম তাদের হাতে দড়ি বাঁধা আমার ছাগলের একটি। আমার ধারণা হলো, নিশ্চয়ই ছাগল তাদের গাছ খেয়ে ফেলেছে। তারা কিছু বলল। আমি কিছুই বুঝলাম না। কয়েকজন বাঙালি আমাকে বলল যে, তারা আমার ছাগলটি নিয়ে যেতে চায়। তাদের খাবারের অভাব। তারা আমার ছাগলকে খাবে তা বুঝতে পেরেই আমি অঝোরে কেঁদে ফেললাম। আমার হঠাৎ কান্নায় কিংবা অন্য কোনো কারণেই তারা ছাগলটি আর নেয়নি। গল্পটি বললাম এ কারণে যে, পোষা প্রাণীর মায়া অনেক। তাকে ছেড়ে মানুষ আশ্রয় নেবে আশ্রয়কেন্দ্রে, তা ভাবা গল্পের মতোই। পাথরঘাটায় সাগরের শব্দ আমরা পাচ্ছি। বিকাল ৪টার দিকে। আমাদের দেখা শেষ। এবার ফেরার পালা। ঘাটে এসে দেখি কোনো নৌকা নেই। বাতাসের গতি বেড়ে গেছে। আকাশ ঘন কালো। আমাদের মাঝি জানত যে, আমরা ফিরে আসব। তাই সে বসে আছে। বলল, পারাপার বন্ধ। আকাশের অবস্থা খারাপ। তাড়াতাড়ি চলুন। ততক্ষণে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। আমাদের পক্ষে ছাতা ঘরে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই পলিথিনে ব্যাগ মাথায় দিয়ে মাথা রক্ষা করে আমরা নদী পার হলাম। সন্ধ্যায় আস্তানায় ফিরে টিভি দেখতে যাব, তখনই দেখা গেলা বিদ্যুৎ নেই। আমি নিজে তখন দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষের একজন পরিচালক। স্থানীয় প্রকৌশলীকে ফোন করলে তিনি জানালেন, নদীর মাঝখানে সঞ্চালন লাইন ভেঙেছে, তাই ঝড় না থামা পর্যন্ত কিছু করা সম্ভব না। রাত ২টায় আমাদের চারপাশে মাইকিং শুরু হলো— ৭ নং বিপদসংকেত। লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আবেদন করছে। জানা গেল, সাইক্লোন রেশমি আঘাত হানছে। বাতাশের শব্দ ভয় পাইয়ে দেয়ার মতো। কিন্তু তিনতলা ভবনে আমাদের অতটা ভয় ছিল না। সারা রাত তুমুল ঝড়ের পর সকালে ছিল বৃষ্টি আর বাতাস। ওই দিন আমাদের যাওয়ার কথা জেলখানায়। সফরসূচিতে অন্তত তা-ই লেখা ছিল। বরগুনার জেল আমাদের আস্তানা থেকে ১০-১৫ মিনিটের পথ। তাই আমার টিম ভাবল, বৃষ্টি হলেও আমরা যেতে পারব। লোকজন অপেক্ষা করবে। তাই রওনা হলাম। গাড়িতে উঠেই প্রথম লক্ষ করলাম যে, গাড়িটি উল্টো পথে যাচ্ছে। কিছুটা অবাক। কারণ জেলখানা ওদিকে নয়। তারপর ভাবলাম হয়তোবা ঘুরে যাবে। কিছুক্ষণ পর আমাদের গাইড জানালেন যে, আমরা যাচ্ছি যে গ্রামে, তার নাম জেলখানা। তার সঙ্গে স্থানীয় জেল কর্তৃপক্ষের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছুটা অবাক, এমন নামও হয়! প্রায় আট কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখা গেল, গাড়ি আর যাবে না। আমাদের গাইড, যিনি একজন এনজিও কর্মী, বললেন— স্যার, এবার রিকশায় যেতে হবে। ব্রিজটি ভাঙা। হেঁটে ওপারে গিয়ে আমরা রিকশায় উঠলাম। দেখতে পেলাম তাকে সবাই চেনে। ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস বললাম, আপনি তো দেখি বেশ পপুলার! তিনি মুচকি হাসলেন। আরো প্রায় তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর তিনি বললেন, স্যার এবার হাঁটাপথ। কত দূর? আরো তিন-চার কিলোমিটার পথ। সাবধানে হাঁটবেন স্যার, বৃষ্টি আর কাদায় পিচ্ছিল পথ। যেতে যেতে গল্প হচ্ছিল। যতই যাচ্ছিলাম ততই তার পরিচিতি বাড়ছিল। আশ্চর্য আপনাকে সবাই চেনে? আবারো মুচকি হাসি। এক স্থানে এক বুড়ো মহিলা এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদলেন অনেকক্ষণ। মা আপনাকে দেখতে যেতে পারিনি, তবে আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করেছি। কী হয়েছিল আপনার? ও স্যার, আমি মোটরসাইকেলে এসব গ্রামে আসতাম। মাস দুয়েক আগে একটি দুর্ঘটনা হয়েছিল। আজই প্রথম বের হলাম। এমন দুর্যোগের দিনে কেন বের হলেন? আপনার অন্য কোনো সহকর্মীকে দিলেই হতো। না স্যার, এ গ্রামে সবাই আমাকে চেনে। তারা আমার কথায় যেকোনো স্থানে চলে আসবে। আপনি যাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন, তারা এই দুর্যোগের দিনে কেবল আমি এসেছি জেনেই আসবে। কী করেছেন আপনি এদের জন্য? এই যে দেখছেন এ গ্রামে যত শাকসবজি, সব বীজ আমাদের দেয়া। দেখুন পুকুরের ওপর মাচা করে লাউগাছ হয়েছে। পুকুর ঠাণ্ডা থাকে। মাছের ফলন বাড়ে। প্রশিক্ষণ আমার দেয়া। এই যে রাস্তায় আমরা হাঁটছি, এখানে মাটি দিয়ে আমরাই রাস্তা সচল করেছি। তবে স্যার দুর্যোগের পর প্রথম প্রয়োজন পানি আর শুকনো খাবার। অধিকাংশ গ্রামে তা আমাদের সংস্থাই পাঠিয়েছে। পথিমধ্যে এক ভিক্ষুক মহিলা (যার একটি পা নেই) তাকে জড়িয়ে ধরলেন। মা আমার বাড়িতে চলো। তোমার জন্য বসে আছি এই বৃষ্টির মধ্যে। বুঝতে পারলাম সবার চোখের মণি তিনি। প্রায় ৪০ মিনিট হাঁটার পর এল সেই গ্রাম। জেলখানা তার নাম।
গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলছি। বুঝতে চেষ্টা করছি কী করে ত্রাণ পৌঁছানো সহজ ও দক্ষতার সঙ্গে করা যায়। নানাজনের নানা কথা। তবে পানি আর শুকনো খাবারের প্রয়োজনীয়তা সবাই বলল। এক পর্যায়ে জানতে চাইলাম, সিডরের পর কে প্রথম নিয়ে এসেছিল আপনাদের জন্য ত্রাণ? কোনো এনজিও? কোনো সংস্থা? কোনো প্রতিষ্ঠান? তারা বলল, কেউ না স্যার। কেন? এতগুলো সংস্থা এখানে কাজ করছে কিন্তু কেউ আসেনি? স্থানীয় এক বয়স্ক ব্যক্তি বললেন, স্যার এটা তো জেলখানা। মানে? মানে স্যার আপনি এক বছর পর এখানে এলেন। কীভাবে এলেন? গাড়ি- রিকশা-হাঁটাপথ। ত্রাণের গাড়ি এ গ্রামে আসবে কীভাবে? সিডরের পর অবস্থা আরো খারাপ ছিল। হুম, তাহলে আপনারা কি ভাঙা ব্রিজের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ত্রাণের জন্য? কী যে বলেন স্যার, ওই গ্রামের লোক আমাদের দাঁড়াতে দিলে তো? কেন? স্যার ওরাও তো সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা ওখানে গেলে তারা ত্রাণ কম পাবে। তাই দাঁড়াতে দিত না। কী আশ্চর্য! আমরা ঢাকা থেকে দুর্যোগ হলেই তো ত্রাণ দিতে চলে আসি। আমাদের ছাত্ররা দলবেঁধে আসে। ওগুলো কোথায় যায়? স্যার, ওগুলো প্রধানত যায় শহরের আশপাশে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসার সুযোগও তাদের হয় না কিংবা সম্ভবও হয় না। তাহলে শেষ পর্যন্ত কি আপনারা ত্রাণ পানইনি? না, স্যার পেয়েছি! কীভাবে? মেম্বার সাব এনেছেন! কীভাবে? স্যার ডিসি স্যাররা সব ইউনিয়নের জন্যই বরাদ্দ দেন। তখন আমাদের মেম্বার সাব কষ্ট করে এনেছেন। তার কাছে আমাদের মূল্য অনেক। তিনিই ত্রাণ এনে আমাদের মাঝে বিতরণ করেছেন। আমরা তো মেম্বার-চেয়ারম্যানদের জানি দুর্নীতিপরায়ণ লোক হিসেবে। স্যার তিনি যত খারাপই হোন না কেন দুর্যোগে তিনিই আমাদের কাছে সবার আগে আসেন। কারণ তিনি জানেন, আমদের ভোটেই তিনি নির্বাচিত হবেন। আমাদের জন্য তার এক ধরনের টান আছে।
যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের মাঝে যথেষ্ট উত্সাহ দেখা দেয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার। এই উত্সাহ থাকাটা যেমন প্রয়োজন, তেমনি ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থায় একটি প্রটোকল তৈরি করা জরুরি বলে মনে করি। তাতে আমাদের দেয়া ত্রাণসামগ্রী সঠিক স্থানে পৌঁছবে। সব ক্ষতিগ্রস্তই যেন ত্রাণের আওতায় আসে তা-ই হবে আমাদের লক্ষ্য। কাছের কিংবা দূরের সবাই দুর্যোগের দিনে সমমাত্রায় ত্রাণের দাবিদার। বিষয়টি সবাইকে ভেবে দেখার আবেদন করছি।
লেখক: পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটি
পাঠকের মতামত