সম্পাদকীয়
ডিজিটাল টাকা নাকি ডিজিটাল টাকার ব্যবসা— কোনটি চাই?
গত কয়েক মাসে গবেষণার কাজে গিয়েছিলাম প্রথমে চীন ও পরে ভারতে। দুটোই বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। একটি কালো টাকা ধরতে আসল টাকাই বাতিল করেছে, অন্যটি টাকার বদলে ব্যবহার করছে ‘ডিজিটাল টাকা’। কী এই ডিজিটাল টাকা, সেটি সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে এ লেখা। আপনি হয়তো ভাবছেন যে, বিকাশ এক ধরনের ডিজিটাল টাকা, তাই এর চেয়ে আর কী নতুনত্ব হতে পারে? তা নয়।
চীনের জিয়ামেন শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম আগেই। সেখানে থাকে আমার এক আপনজন। তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ঘুরে দেখছিলাম সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়। সুন্দর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয়টির। মনেই হবে না কোনো উন্নয়নশীল দেশ এটি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস। সমস্যা একটাই— ইংরেজদের ভাষা অচল। সেই সঙ্গে তাদের টাকাও। অর্থাৎ ডলার, পাউন্ড কিংবা ইউরো কোনোটাই চলবে না। ভাবলাম হয়তোবা আরএমবি— চীনা টাকা চলবে। কিন্তু হোঁচট খেলাম সাইকেল দেখতে গিয়ে। চীনের প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই সাইকেল চালানোর জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। তাতে বায়ুদূষণ কমবে। কাজটি করছে একটি প্রাইভেট কোম্পানি। তাদের সাইকেল শহরের সব মোড়ে পাওয়া যাবে। এর একটি নিয়ে আপনি চলে যেতে পারবেন শহরের যেকোনো স্থানে। গন্তব্যে পৌঁছে সাইকেলটি একটি মোড়ে রেখে গেলেই চলবে। ফেরত আনতে হবে না। কী করে ফেরত আসবে বাইকটি? তা নিয়ে আপনার ভাবার দরকার নেই, অন্য কেউ তা ফিরিয়ে আনবে। আর না আনলেই বা ক্ষতি কী? অন্য কোনো স্থানের একটি সাইকেল হয়তো এরই মধ্যে কেউ আপনার বাড়ির মোড়েই রেখে গেছে। অতএব সমানে সমান।
জানতে চাইলাম, কী করে একটি বাইক পাওয়া যায়? উত্তর এল উইচ্যাট মানি দিয়ে পাওয়া যাবে বাইকটি। মানে? তুমি উইচ্যাট দিয়ে টাকা জমা দিয়ে বাইকটি নেবে, আর যখনই তা কোথাও রেখে যাবে তখন কোম্পানিটি ভাড়া কেটে রেখে দেবে। কীভাবে? উইচ্যাট থেকে? অবাক হওয়ার পালা। উইচ্যাট তো জানতাম হোয়াটস অ্যাপজাতীয় একটি চাইনিজ অ্যাপ। এখানে টাকার লেনদেন কীভাবে হয়? জানবে কিছুক্ষণ পরই।
কিছুক্ষণ পর আমরা বাসে করে শহরে বেড়াতে গেলাম। ওমা! বাসে চীনা টাকা দিতে গিয়ে বুঝলাম ভাংতি নেই। অর্থাৎ যত টাকা ভাড়া, ততই দিতে হবে। ভাংতি নেই বাসে। কী করি? আমার কাছে তো বড় নোট। কোনো অসুবিধা নেই। উইচ্যাট দিয়ে দেয়া যাবে। কীভাবে? কিউআর কোড স্ক্যান করে নাও মোবাইলে, তারপর টাকা চলে যাবে বাস কোম্পানিতে? কোত্থেকে টাকা যাবে? উইচ্যাট থেকে। উইচ্যাটের সঙ্গে আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ট্যাগ করা আছে— অনেকটা ডেবিট কার্ডের মতো। কোনো কার্ড ছাড়াই কাজ হবে। ও আচ্ছা। জ্ঞানার্জনের জন্য চীন দেশেও যাও, কথাটার অর্থ বুঝলাম এতদিনে!
শহরে কিছুক্ষণ হাঁটার পর মনে হলো, একটু জুস খেতে পারলে তৃষ্ণা মেটানো যেত। দেখতে পেলাম একটি ভ্যান্ডিং মেশিন। জুসও রয়েছে তাতে। গেলাম মেশিনের কাছে। কিন্তু এ কি! টাকা কিংবা ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দেয়ার কোনো জায়গা নেই! কী করা? কোনো চিন্তা নেই, আছে উইচ্যাট মানি। কিছুটা অবাক। মেশিন কী করে আমার মোবাইলের সঙ্গে সংযুক্ত হবে? দেখা যাক কী হয়! জ্ঞানার্জনের আরো কিছু বাকি আছে। দেখা গেল মেশিনের গায়ে রয়েছে একটি কিউআর কোড। মোবাইল দিয়ে স্ক্যান করার পর দেখা গেল মেশিনে যত পণ্য রয়েছে তার, আমার মোবাইলে দেখা যাচ্ছে। জুসের ছবির গায়ে টিপ দেয়ামাত্রই টপ করে জুসের বোতলটি পড়ে গেল নির্ধারিত স্থানে। তৃষ্ণা মেটানো গেল, তবে এবার আমার নিজের অন্য তৃষ্ণা বেড়ে গেল। এর সঙ্গে আমাদের বিকাশের পার্থক্য কী? আমাদের বিকাশে টাকা দেয়ার সময় কোড দিতে দিতে প্রাণ উড়ে যায়। কোথায় কী ভুল হয়, কখন আবার সময় চলে যায়! চশমাটা হাতের কাছে না থাকলে কি টিপতে কি টিপে ফেলি! কী ভুল করে ফেলি! আমাকেও আতঙ্কে থাকতে হয় সবসময়! যে জাতির অধিকাংশ মানুষ অংক জ্ঞানে অপটু, সেখানে কেন এতসব নম্বর টেপাটেপি!
আমার নিজেরও একটি বিকাশ অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তা থেকে সহজে কিছু করতে যাই না। কারণ এটাকে ঠিক টাকা বলা যায় না। কিছু করতে গেলেই ২ শতাংশ কেটে রাখে। অর্থাৎ ১০০ টাকার বাজার করতে গেলে ১০২ টাকা দিতে হয়। ১ হাজার টাকা দিতে গেলে ১ হাজার ২০ টাকা দিতে হবে। অংক আর বড় করলাম না। কারণ ১০ হাজার টাকায় কত দিতে হবে শুনলে ভয় পাবেন! বহুদিন ধরে একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, মোবাইলে ১০০ কিংবা ১ হাজার টাকা পাঠাতে বা ১০ হাজার টাকা পাঠাতে কোডের আকার কি এতই বড় হয়ে যায় যে টাকার অংক গুণিতক হারে বেড়ে যায়?
আমাদের দেশে এর ওপর রয়েছে ডিজিটাল অর্থনীতিতে অ্যানালগের ঝামেলা। রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জুজুর ভয়ে থাকে তারা। পকেট থেকে ১০ হাজার টাকা কেন, ১০ লাখ টাকা লেনদেন করলে কেউ টের পায় না, কিন্তু ডিজিটাল আকারে পাঠাতে হলে তাদের ভয় অনেক। তাই রয়েছে সর্বোচ্চ কত টাকা দেয়া যাবে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ। মানি লন্ডারিংয়ের ভয়! ভেবে দেখুন, আপনি ক্যাশে একজনকে ৫ লাখ টাকা দিন, কেউ টেরও পাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখার সুযোগই নেই। তাতে মানি লন্ডারিং হয় না, কিন্তু বিকাশে ১০ হাজার টাকা পাঠালে মানি লন্ডারিং হবে। অথচ এক্ষেত্রে কে, কোত্থেকে, কাকে টাকাটা পাঠাচ্ছে, সবই থাকছে তথ্যভাণ্ডারে! এখানে কী করে মানি লন্ডারিং হয়, তা বোধগম্য হয় না।
তবে হাঁ, বলতে পারেন টাকা চুরি হয়ে যাবে, সেই ভয়ে হয়তো এ সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে! তাই যদি হয়, তবে তার অধিকার তো আমার হাতে থাকবে। আমি অ্যাকাউন্ট করার সময় বলে দিতে পারি যে, আমার অ্যাকাউন্ট থেকে একসঙ্গে আমি ১০ হাজার টাকার বেশি কোনো লেনদেন করতে চাই না। ইচ্ছা করলে আমি ৫০০ টাকার সীমাও বেঁধে দিতে পারি। কথায় বলে, মামার চেয়ে মাসির দরদ বেশি। এটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আমাদের ডিজিটাল টাকার সঙ্গে চীনের ডিজিটাল টাকার গুণগত কিছু পার্থক্য রয়েছে, যা সবার নজরে আনছি (তাতে যদি কিছু পরিবর্তন হয়!)। আমাদের ডিজিটাল টাকার মাধ্যমে আপনি সীমিত কিছু লেনদেন করতে পারেন, যেখানে আপনাকে কোনো ধরনের অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয় না। যেমন ধরুন, আপনি যদি মোবাইলে টাকা দিতে চান, তবে কোনো ফি নেই। কিন্তু দেখুন, আপনার বাবার কাছে টাকা পাঠাতে চান? না, সেখানে দিতে হবে ২ শতাংশ। কেন? আমি তো আমার বাবার বিকাশ অ্যাকাউন্টেই টাকাটা পাঠাতে পারতাম! তিনি তা দিয়ে যদি পানওয়ালাকে ২ টাকা দিতে চান, তবে আমাকে বা তাকে কেন ২ শতাংশ দিতে হবে? আমরা কি ডিজিটাল টাকা বানিয়েছি, নাকি ডিজিটাল টাকার ব্যবসা বানিয়েছি? এ টাকা কি আসলেই টাকা? নিশ্চয়ই না। কারণ টাকার মূলমন্ত্রের একটি হচ্ছে, তার ব্যবহারে কোনো ফি নেই। আমি ১০০ টাকার জিনিস কিনলে ১০০ টাকাই দেব। বেশি নয়। মোবাইল অপারেটরগুলো এ ব্যবসার অংশীদার হতে পারে না কিংবা তা হতে তারা কমিশন নিতেও পারে না। তাদের কাজ ডিজিটাল তথ্য আদান-প্রদানের সময় নির্দিষ্ট হারে ফি গ্রহণ করা। যেমন— আমরা মোবাইলে কথা বললে প্রতি সেকেন্ডের জন্য একটি ফি নিয়ে থাকে। ১০০ টাকা কিংবা ১ হাজার টাকা পাঠাতে ফির পার্থক্য কেন হবে? সেকেন্ড বেশি লাগে?
এবারে আসি দ্বিতীয় একটি বিষয়ে। বিকাশ কিংবা রকেটজাতীয় সার্ভিস প্রদানের জন্য দুই ধরনের খরচ রয়েছে। একটি এসব কোম্পানির বিশাল কম্পিউটার সিস্টেম থাকতে হবে, যাতে কেবল লেনদেনের যাবতীয় হিসাব সংরক্ষণ করা হবে তা নয়, তারা গ্রাহকদের অর্থের যাবতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করবে, যাতে কেউ আমার অর্থ চুরি কিংবা ডাকাতি করতে না পারে। এ দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। জানি, এ পদ্ধতি কখনই শতভাগ আশঙ্কামুক্ত হবে না। তাই তাদের প্রয়োজনে একটি ইন্স্যুরেন্সজাতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর দ্বিতীয় খরচ হলো, নগদ অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে যারা জড়িত (যেমন এজেন্ট), তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থ সংরক্ষণ করতে হয়। এ অর্থ সংরক্ষণের জন্য একটি খরচ রয়েছে। ফলে বিকাশজাতীয় অ্যাকাউন্টে লেনদেন করতে হলে এ খরচও দিতে হয় গ্রাহককে। অর্থাৎ একটি বিকাশজাতীয় লেনদেনের জন্য তিনটি দল কমিশন পায়। প্রথমত. কোম্পানি নিজে, দ্বিতীয়ত. মোবাইল অপারেটর ও তৃতীয়ত. এজেন্ট। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি বাহুল্য, তা আমি আগেই বলেছি। এবার ধরুন, আমরা লেনদেনকে ক্যাশবিহীন করে ফেলি, সেক্ষেত্রে আমি মাছ কেনার সময় আমার বিকাশ থেকে দোকানির বিকাশে দিয়ে ফেলি, তাতে কি মানি লন্ডারিং হবে? আমি আমার বিকাশ থেকে যত খরচই করি না কেন, তার সব তথ্য ডিজিটালি থাকবে। ভয়টা কোথায়? অথচ তা না করে ডিজিটাল টাকাকে নগদ টাকায় রূপান্তর করতে গিয়ে শুধু যে কমিশন দিতে হয় তা নয়, আমাকে জীবনঝুঁকিও নিতে হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে কেনিয়ায় যখন প্রথম এমক্যাশের সূচনা হয়, তখন তাদের মূল লক্ষ্য ছিল কী করে মানুষকে ক্যাশ লেনদেন থেকে সরিয়ে নেয়া যায়, তার পরিবেশ সৃষ্টি করা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নগদ অর্থ হাতে কিংবা ঘরে রাখায় জীবনঝুঁকি বাড়ে। এই নগদ অর্থের ঝুঁকি এড়াতে গিয়ে এমক্যাশের সৃষ্টি। কথায় বলে, আমরা ভালোটা দেখি না, খারাপটা আগে দেখি।
নগদ লেনদেন অব্যাহত রাখতে সরকারেরও অনেক খরচ হয়। তাই যতই নগদ লেনদেন কমবে ততই সরকারের খরচ কমবে। কী কী খরচ? টাকা প্রিন্ট করতে খরচ হয়, টাকাকে নকল থেকে সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরিতে খরচ হয়। টাকা সংরক্ষণ ও স্থানান্তরে খরচ হয়। এই সব খরচই চলে যাবে যদি আমরা নগদ লেনদেনের মাত্রা কমিয়ে আনি।
তার ওপর আমরা জানি যে, নগদ লেনদেন সরকারের নজরদারির বাইরে থাকে। ফলে দুর্নীতি সহজ হয়। অথচ ডিজিটাল লেনদেন থাকে সরকারের নখদর্পণে। তাই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে ডিজিটাল টাকার বিকল্প নেই। আমরা এতসব জেনেও কি না জানার ভান করছি? আমরা উল্টো গান গাইছি। বলছি, ডিজিটাল লেনদেন মানি লন্ডারিং কাজে সহায়তা করে! শুধু তা-ই নয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি করতে গিয়ে আমরা হয়তো অজান্তে ডিজিটাল ব্যবসার ফাঁদ তৈরি করছি। আমরা ক্রমে আসল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের উচিত ডিজিটাল টাকার উপকারিতা বুঝে ডিজিটাল টাকা তৈরি ও চালু করা। অথচ বর্তমান ব্যবস্থা কোনো অবস্থাতেই ডিজিটাল টাকা চালু আর ডিজিটাল টাকার ব্যবসা বন্ধ করার পক্ষে সহায়ক নয়।। আশা করি পরিবর্তন আসবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট
পাঠকের মতামত