সম্পাদকীয়
স্বর্ণমুদ্রা থেকে রহস্য মুদ্রা পরিবর্তনের ইতিকথা
মুদ্রা কী, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে আপাতত তেমন বিরোধ নেই। বর্তমানে আমাদের কাছে মুদ্রা হলো টাকা, ভারতীয়দের কাছে তা রুপি, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তা ডলার। এই মুদ্রা কীভাবে এল, তা নিয়ে আমাদের স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও বলা যায়, আমাদের দেশে তা তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা সরকার। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এক কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে আমার শিক্ষকতা জীবনে সবচেয়ে বেশি অবাক হই, যখন দেখি আমার অনেক ছাত্রই মনে করে, সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপে স্বর্ণের বিনিময়ে। অবাক হই এ কারণে যে, ১৯৪৫ সালের পর অর্থ কখনই স্বর্ণের বিনিময়ে ছাপা হয়নি। অথচ এখনো অনেকের তা-ই ধারণা। এ ধারণা কোত্থেকে এসেছে, তা গবেষণার বিষয়। কারণ যা বলা হয়নি, তা কী করে বর্তমান প্রজন্মের মাথায় ঢুকে গেল? কে ঢুকাল? তা জানতে মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার প্রয়োজন। এ ধারণা কি গল্প থেকে এসেছে? নাকি এসেছে রূপকথা থেকে? নাকি আমাদের জিনের মধ্যে একসময় ঢুকে গেছে, তা নিশ্চয়ই গবেষণার বিষয়!
অর্থনীতির পরিভাষায় অর্থ একটি বিনিময় মাধ্যম, এর মাধ্যমে আমরা কেনাবেচা করে থাকি। তবে এর বাইরেও অর্থের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত. এর বিশ্বাসযোগ্যতা, দ্বিতীয়ত. বাজারে এর বিনিময় গ্রহণযোগ্যতা, তৃতীয়ত. মান ধরে রাখার ক্ষমতা অর্থাৎ বিভিন্ন সময়ে অর্থের পরিমাণ একই থাকে। যেমন— ১০০ টাকার নোট ১০০ টাকাই। বাড়ে বা কমে না (তবে অর্থের ক্রয়ক্ষমতা এক থাকে না)। প্রশ্ন হতে পারে, তবে অর্থের আকার কী হবে? মুদ্রার এ ক্ষমতা আছে বলেই আমরা লক্ষ টাকার ঋণ পরিশোধ করতে লক্ষ টাকাই ফেরত দিই। সুদ থাকলে আমরা যদিও সুদসমেত ফেরত দিই, তবে সুদ না থাকলে আমরা কিন্তু লক্ষ টাকাই ফেরত দেব। অর্থাৎ সুদের হার শূন্য না হলেই কেবল আমরা অধিক অর্থ ফেরত দিই। এ সুদ শূন্য বা এর অধিক যেকোনো হার হতে পারে। কীভাবে সুদের হার নির্ধারিত হয়, তা ভিন্ন বিষয়। তাই আলোচনায় গেলাম না। আজ আমার আলোচনা ‘অর্থ’ নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে।
অর্থ বা মুদ্রার ব্যবহার বেশ প্রাচীন। এর স্বরূপ বহুবার বদলেছে। একসময় সামুদ্রিক ঝিনুক বা কড়িও অর্থ হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। বাজার যতই বিস্তৃত হয়েছে, ততই অর্থের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয়ভাবে কড়ি বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হলেও আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্যের সময় কড়ির গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পায়। ফলে প্রচলিত হয় ধাতব মুদ্রা। ধাতব মুদ্রায় ধাতব পদার্থের মানই অর্থ হিসেবে ব্যবহূত হয়। এরই সূত্র ধরে একসময় স্বর্ণ অর্থ হিসেবে ব্যবহূত হয়। এর গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনীন, তাই সবাই তা গ্রহণ করে। চালু হয় স্বর্ণমুদ্রা। তাও খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালের কথা। স্বর্ণমুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনীন হওয়ায় অতি সহজেই তা আন্তর্জাতিক মুদ্রায় পরিণত হয়। জাহাজভর্তি পণ্য এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে চলে যায় আর ফেরত নিয়ে আসে স্বর্ণ। এতে বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরে স্বর্ণের পরিমাণ ক্রমেই বড় হতে থাকে। সভ্যতার পরিবর্তনও হয় এরই সূত্র ধরে। যে সম্রাট বেশি স্বর্ণের অধিকারী, তিনি ততই ধনী। শুরু হয় স্বর্ণ আহরণের স্বর্ণযুগ। দেশ হতে দেশান্তরে শুরু হয় স্বর্ণখনির অধিকার ও আহরণ। কেউ স্বর্ণ আহরণ করে লুট করে, কেউ খনি দখল করে স্বর্ণ পায়। বেধে যায় যুদ্ধ। সবার স্বর্ণ প্রয়োজন। অন্যদিকে যেসব দেশ বাণিজ্যে সমৃদ্ধ, সেগুলো স্বর্ণ আহরণ করে পণ্যের বিনিময়ে। তাই দেখবেন, ইউরোপ যখন স্বর্ণখনির অধিকার কিংবা সামুদ্রিক জাহাজ লুট করা নিয়ে বিবাদে রত, তখন ভারত মহাদেশ ও চীন বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বর্ণে সমৃদ্ধি অর্জন করে।
তবে কথায় বলে স্বর্ণযুগেরও পতন সম্ভব। একসময় প্রকট হয় জাতিত্ববোধ। সব জাতি মনে করে তারাই শ্রেষ্ঠ। তাদের সম্পদ প্রচুর। বাণিজ্যের ফলে সম্পদ পাচার হয়ে যায়। অর্থাৎ আমরা যখন স্বর্ণের বিনিময়ে পণ্য কিনি, তখন একসময় পণ্য ভোগে শেষ হয় আর স্বর্ণ থেকে যায় অন্যদের হাতে। এ অবস্থায় বাণিজ্য ঘাটতি মানেই হলো স্বর্ণ চলে যাওয়া। অন্যদিকে স্বর্ণ প্রজাদের হাতে মজুদ থাকলে একসময় প্রজারা রাজার চেয়েও বেশি সম্পদশালী হয়ে যেতে পারে। তাই চালু হয় ধাতব মুদ্রা। রাজার আইন। স্বর্ণ থাকবে রাজার কোষাগারে আর ধাতব মুদ্রা থাকবে মানুষের পকেটে! তাতে লেখা থাকবে, এ মুদ্রা নিয়ে এলে রাজা তাকে সমপরিমাণ স্বর্ণ দেবেন। এক কাজে দুই কাজ হয়। প্রথমত. চালু হওয়ার পর দেখা গেল, কেউ আর কোষাগার থেকে স্বর্ণ উঠাচ্ছে না। মুদ্রাই বিনিময়ের কাজ করছে। রাজার প্রতি প্রজাদের অগাধ বিশ্বাস। রাজা স্বর্ণের মালিক আর প্রজারা মুদ্রার বিনিময়ে সম্পদশালী! দ্বিতীয়ত. রাজার সার্বভৌম ক্ষমতা সম্প্রসারিত হয়। যত দূর পর্যন্ত রাজার মুদ্রা প্রচলিত থাকবে বা গ্রহণীয় হবে, তত দূর পর্যন্ত রাজার প্রতি আস্থা বিরাজমান। অর্থাৎ রাজার রাজ্য বিস্তৃত! কিন্তু একসময় দেখা যায়, ধাতব পদার্থের দাম পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে রুপার বদলে চালু হয় অন্যান্য ধাতব মুদ্রা। ধাতব পদার্থের বাজারদরে ওঠানামার ফলে মুদ্রার ক্ষমতা হ্রাস পায়। কেউ কেউ মুদ্রাকে ধাতব পদার্থে পরিবর্তন করে ফেলে। এতে প্রয়োজন হয় আরেক দফা পরিবর্তনের। পৃথিবীর সমৃদ্ধতম দেশ চীন তাই প্রথম চালু করে কাগজের মুদ্রা, ত্রয়োদশ শতকে।
মুদ্রার জগতে ধাতব মুদ্রা প্রচলিত থাকলেও ক্রমে কাগজি মুদ্রা বা নোট চালু হয়ে যায়। তবে এর গায়েও লেখা থাকে সেই পুরনো গাথা— চাহিবামাত্র বাহককে সমপরিমাণ স্বর্ণ দিতে বাধ্য থাকিব। কাগজি মুদ্রার এ সংস্করণটি এখনো প্রচলিত, তবে কথা কিছুটা বদলে গেছে। ১০০ টাকায় বলা হয়— চাহিবামাত্র বাহককে ১০০ টাকা দিতে বাধ্য থাকিব। তাহলে ১০০ টাকার নোটটি আসলে কী? এটি একটি টোকেন মাত্র। এর প্রতি আমাদের বিশ্বাস যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ তা আপনি পকেটে রাখবেন। বিশ্বাস না হলে তা রাখবেন না। কথাটি কি বিশ্বাস হয়?
সম্ভবত ১৯৯৭-এ গিয়েছিলাম ইন্দোনেশিয়ায়। পকেটে ডলার। জাকার্তা বিমানবন্দরে যখন ডলার ভাঙিয়ে রুপিয়াহতে পরিণত করতে যাব, তখন আমাদের গাইড বলল, স্যার প্রয়োজন না হলে টাকা ভাঙাবেন না। কেন? তাদের মুদ্রার প্রতি তাদের বিশ্বাস নেই! দেখা গেল তাই। ইন্দোনেশিয়ার রুপিয়াহ তখন ডুবছে। প্রতিদিন দাম কমছে ডলারের বিপরীতে। খোদ জাকার্তাবাসী তাদের রুপিয়াহর বদলে ডলার বগলদাবা করছে। আইন করেও তা বন্ধ করা যাবে না। অর্থাৎ অর্থ শেষ পর্যন্ত একটি বিশ্বাস। যেদিন এ বিশ্বাস থাকবে না, সেদিন আইন অর্থকে রক্ষা করতে পারবে না। এ বিশ্বাস তৈরি করতে প্রয়োজন সেই রাজার, যাকে প্রজারা আস্থায় রাখবে। আধুনিক যুগে এ আস্থা তৈরি করে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনা।
বলে রাখা ভালো, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপ যখন নতজানু, তখন ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রমাদ গুনতে থাকে। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সব দেশই এবার স্বর্ণ ফেরত চাইবে। ধারণা করুন, ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে তাদের হাতের সব পাউন্ড এক করে সমপরিমাণ স্বর্ণ ফেরত চাইলে কী হতো? কী পরিমাণ স্বর্ণ রাজকোষাগার থেকে ভারত ও পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে হতো? তাই ১৯৪৫ সালে স্বাধীনতার আগেই ঔপনিবেশিক শাসকরা একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার ফলে সৃষ্টি হয় ব্রেটন উডস্ প্রতিষ্ঠানগুলো। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক। চুক্তির মাধ্যমে সব দেশ স্বর্ণের সঙ্গে তাদের মুদ্রার সরাসরি সম্পর্ক ছিন্ন করে। মুদ্রা আর স্বর্ণের সম্পর্ক থাকে না। সব সরকার যার যার টাকা ইচ্ছামতো তৈরি করবে। বদল হয় বিশ্বাসের। তাই তো ১০০ টাকার নোটে লেখা হয়, চাহিবামাত্র ১০০ টাকা দিতে বাধ্য থাকিব। এ বিশ্বাসই ১০০ টাকাকে ১০০ টাকায় পরিণত করেছে।
বিষয়টি এখানেই শেষ হতো, তবে হয়নি। টাকার মান ধরে রাখার চেয়ে টাকার বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাকা নকল করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। তাই টাকার পেছনে ব্যয় ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। বুদ্ধিমান দেশগুলো নোটের অংক কমিয়ে ফেলে। অর্থাৎ ১০০ টাকার নোট নকল করে লাভ ১ হাজার টাকা নকলের চেয়ে অনেক কম। তাই দেখা যায়, বড় নোটের নকল বেশি হয়। সরকার বাধ্য হয়ে জনগণকে টাকা ছাপানোর অধিকার দেয়। আশ্চর্য হচ্ছেন? ভেবে দেখুন, ১০ হাজার টাকার বাজার করতে আপনি কি ১০ হাজার টাকা নাকি ১০ হাজার টাকার একটি চেক, কোনটিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন? নিশ্চয়ই চেক। তাই অনেক দেশ বড় লেনদেনের ক্ষেত্রে চেকের ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়। আইনও সংশোধন করে, যেন প্রতারণার জন্য চেকদাতাকে অতি সহজেই বিচারের আওতায় আনা যায়। আপনার দেয়া চেকই তখন বাজারে নোটের কাজ করতে থাকে। যেহেতু চেক ব্যাংকিং ব্যবস্থার একটি সনদ, তাই তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নিয়মনীতি দ্বারা দেশে মুদ্রাপ্রবাহ বজায় রাখে। প্রয়োজন হয় মুদ্রানীতির।
শেষ এখনো হয়নি। বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করতে অধিকতর আগ্রহী হয়। যদিও স্বর্ণের সঙ্গে অর্থের কোনো সম্পর্ক থাকে না, কিন্তু অনেক দেশই ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রামান বজায় রাখতে অধিকতর আগ্রহী হয়ে ওঠে। কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু তা করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকে। মুদ্রা আবারো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রমাগত বিধিনিষেধের ফলে বিকল্প মুদ্রার চাহিদা বাড়ে। নানা কারণে তা হয়— কোথাও বিধিনিষেধ, কোথাও দেশকে অবিশ্বাস, কোথাও কর ফাঁকি, কোথাও বিচার ব্যবস্থা ফাঁকি, কোথাও নিতান্ত স্বাচ্ছন্দ্য। সৃষ্টি হয় ক্রিপ্টোকারেন্সি বা রহস্য মুদ্রার। এ মুদ্রার কোনো আকার নেই। কোথায় আছে কেউ জানে না। কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। আছে বিশ্বাস। যারা বিশ্বাস করে, তারাই লেনদেন করবে। এ বিশ্বাসধারীদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। অনেক দেশই এখন ভাবছে এই নতুন বিশ্বাসকে ফেলে না দিয়ে গ্রহণ করতে। বেশকিছু দেশ এসব মুদ্রা গ্রহণযোগ্য করে নিয়েছে। আগামীতে সরকার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নতুন চ্যালেঞ্জ— রহস্য মুদ্রাকে কি আইনের আওতায় আনবে নাকি আইনের বাইরে রাখবে। ইতিহাস বলে, আইনের আওতায় একদিন আনতেই হবে। সাম্প্রতিককালে বিটকয়েন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবধান বাণীর পরিপ্রেক্ষিতে আবেদন বিষয়টি আবার ভেবে দেখুন। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কীভাবে পরিবর্তনকে গ্রহণ করবেন, তা শেষ পর্যন্ত বিচার্য।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট
পাঠকের মতামত