সম্পাদকীয়
99 Shares
ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ইত্যাদি আমাদের কাছে এখন আর অজানা নয়। আমাদের দেশে অনেকেরই এসব অ্যাকাউন্ট রয়েছে। কী করে তারা এসব অ্যাকাউন্ট দ্বারা? উত্তরে বলা যায়, কারো উদ্দেশ্য নিছক একাকিত্ব ঘোচানো। অনেকটা কম্পিউটারে বসে সলিটায়ার বা মনোপলি বা দাবা বা সিমসিটি খেলার মতো। তবে পার্থক্য রয়েছে, কম্পিউটার গেমসে অনেক ক্ষেত্রেই একা খেলা যায়, কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে আপনার মূলমন্ত্র হলো অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ। এ যোগাযোগের মাধ্যমে নিজের অনুভূতি অন্যকে জানানো যায়। তারা তার উত্তর দিতে পারে। সরাসরি যোগাযোগ আর এসব যোগাযোগের মধ্যে বেজায় পার্থক্য। আপনি আপনার অনুভূতি যাকে ইচ্ছা তাকে জানাতে পারেন। কারো ভালো লাগলে তা তারা তাদের বন্ধুদের জানাবে। আর এভাবেই দেখবেন আপনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে একটি ‘সমাজ’। এ সমাজে আপনার ভূমিকা কী, তা আদৌ বিবেচ্য নয়। তবে আপনার ‘সমাজে’ কতজন সদস্য রয়েছে, তার দ্বারা আপনার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। যার সমাজ যত বড়, সে তত গুরুত্বপূর্ণ কিংবা বলা যায়, তার মত কিংবা অনুভূতি অনেককে স্পর্শ করে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করার এমন সহজ ও নৈর্ব্যক্তিক সম্পর্ক আর কোথাও তৈরি করা সম্ভব কিনা, তা বোধগম্য নয়। অনেকটা হ্যামিংওয়ের বংশীবাদকের মতো। আপনি আপন মনে বাঁশি বাজাবেন আর আপনার ‘সমাজ’ আপনাকে অনুসরণ করবে। আপনার এমন ক্ষমতা ইহজগতে আর কোথাও ব্যবহার করতে পারবেন কিনা, তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এখানে প্রতিটি ব্যক্তি একেকটি বৃত্তের বা সমাজের কেন্দ্রবিন্দু। আর তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রয়েছে লাখ লাখ ‘সমাজ’। প্রতিটি সমাজ পৃথক। তবে তাদের মধ্যে রয়েছে সম্পর্ক। এ সম্পর্ক কতটা বিস্তৃত, তা বোঝার ক্ষমতা অনেকেরই নেই। মনে করুন, আপনি আর আমি বন্ধু, তাহলেই দেখবেন আপনার বন্ধুও আমার বন্ধু হতে পারে। এবার ধরুন, প্রতি জনের ১০ জন করে বন্ধু রয়েছে আর তারা একে অন্যের বন্ধু, তাহলেই দেখবেন তাদের সম্মিলিত সমাজের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ১০০ হয়ে গেছে। সবাই সবাইকে চেনে আর চেনেও না। সম্পর্ক কেবল মনিটরে। তবে হ্যাঁ, আপনাকে কেন্দ্র করে সমাজ যত বড় হবে ততই আপনার সমাজকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা বাড়বে।
এসব মাধ্যমকে কেউ ব্যস্ত জীবনে অবসরের সাথী বলে মনে করেন। ফলে তারা অবসর হলেই গল্প করেন। বন্ধুদের বলেন দিনটি কেমন গেল, কী ভালো লাগল, কী লাগল না। কেউ কেউ আবার এই একই মাধ্যমকে ব্যবহার করেন জ্ঞানার্জনের জন্য কিংবা নির্জনে বসে গল্প করার জন্য, যার যতটা অবসর, তার ততটা সময় এ সমাজে বাস। তাই কর্মজীবীদের চেয়ে অবসরে বসে থাকা ব্যক্তিদের এসব মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করতে দেখা যায়। যানজটের দেশে যারা বাস করেন, তারা এ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় কথাবার্তাও সেরে ফেলেন। একে অন্যকে দেখেও ফেলেন। মোদ্দাকথা, এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অসম্ভব শক্তিশালী। এসব মাধ্যম যারা তৈরি ও লালন করেন, তাদের নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি বিশাল অর্থনীতি। আর যেখানে অর্থনীতি রয়েছে, সেখানে থাকবে রাজনীতি। তাই এ মাধ্যম ব্যবহার করে রাজনীতিরও প্রচুর চাল দেয়া সম্ভব। শুধু রাজনীতি নয়, এর ব্যবহার বাজার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। বাজারমূল্যকে প্রভাবিত করে। মানুষের মতামতকে প্রভাবিত করে। ভোটকে প্রভাবিত করে। এমনকি মানুষের মানসিকতাকে প্রভাবিত করে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এ সমাজ বাস করে নিভৃতে বা একান্তে। এখানে কোলাহল নেই, আছে নিঃশব্দ চিত্কার। এখানে নেই কোনো সামাজিক নিয়ম বা রীতি। এ সমাজের রীতিনীতি আপনি নিজেই তৈরি করবেন। কাউকে ভালো লাগে না? বের করে দিন। কাউকে উপেক্ষা করতে চান? তাও সম্ভব। কারো কথা শুনতে চান না? তাও সম্ভব। যেহেতু সমাজটি আপনার তৈরি, তাই নিয়মনীতিও আপনার। এমন স্বাধীনতা ইহজগতে আর কোথাও পাবেন কিনা, আমার জানা নেই। ‘সিসিম ফাঁক’ শব্দটি শুনেছেন, আলাদিনের চেরাগ আছে বলে জানতেন কিন্তু ব্যবহার করবেন কেবল এখানেই। অন্য কোথাও নয়।
রূপকথার নায়কের মতন আপনি নিজেকে রূপায়ণ করতে পারবেন। নিজেকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই প্রকাশ করবেন। তাই দেখবেন বিষয়টা নেশার মতো। এখানে নেই কোনো ঝগড়া, নেই বিবাদ। তবে এখানেও রয়েছেন ঈশ্বর। এ ঈশ্বর সব দেখতে পান। তার ক্ষমতাও অসীম। কখনো কখনো তিনি নিজেও জানেন না, তার ক্ষমতা কতটুকু। রয়েছে শয়তান, যাদের কাজ হলো, আপনাকে নানা অপকর্মে উত্সাহিত করা। তবে এখানে শয়তান দুটি। একটি আপনার মনে, অন্যটি ‘সমাজে’র আনাচে-কানাচে। তার কাজ হলো, আপনার মনের শয়তানকে খুঁজে বের করা। উত্সাহিত করা অঘটনটি ঘটাতে। শয়তান থেকে বাঁচার উপায় আপনাকেই বের করতে হবে। কারণ প্রকৃত ঈশ্বরের মতনই এ জগতের ‘ঈশ্বর’ও নীরব। তিনি সবই দেখেন কিন্তু কিছুই করেন না।
এ পর্যন্ত সবকিছু্ই গল্পের মতন। বিপদ অন্যখানে। আপনার এ ‘সমাজ’ কখনো কখনো আমাদের প্রকৃত সমাজের সঙ্গে বিবাদে রত হয় কিংবা আমাদের মনুষ্যসমাজে যখন কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে, তখন আপনার ক্ষমতাকে মনুষ্যসমাজ সীমিত করতে উদ্যোগী হয়। তৈরি করে আইন। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার ‘সমাজ’ আমাদের সমাজকে বেকায়দায় না ফেলে, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার স্বাধীনতা সার্বভৌম ক্ষমতার মতন। আবার আপনি যখন নিজেই একটি সমাজের প্রতিষ্ঠাতা হবেন, তখন নিজেকেও অনেক সময় ঈশ্বর ভাবতে শুরু করতে পারেন। তখন আপনি আপনার ‘ইচ্ছা’ প্রকাশ করবেন মনুষ্যসমাজকে উপেক্ষা করে। ভাববেন কার কী আসে যায়, আমি আমার সমাজকে যা ইচ্ছা তা বলতেই পারি! বলার স্বাধীনতা আমার! কিন্তু কখনো কখনো দেখবেন, আপনার ক্ষমতা অনেকের প্রাণ নিতে উত্সাহিত করতে পারে। সেক্ষেত্রে মনুষ্যসমাজ আপনাকে দায়বদ্ধ করবে। আপনার স্বাধীনতার এ সীমাবদ্ধতা মেনেই আপনাকে সমাজ তৈরি করতে হবে।
দুই শয়তানের মতোই এখানেও দেখা যাবে দুজন ঈশ্বর। একজন যিনি মাধ্যমটি তৈরি করেছেন, আর অন্যজন আপনি। বাস্তবে এখানে প্রচুর ঈশ্বর রয়েছেন। বাস্তব জগতে ধর্ম সৃষ্টির অন্তরালে আমরা যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, তার কোনো নিজস্ব লোভ বা লালসা নেই। কিন্তু এ জগতে তা নয়। যিনি ফেসবুক তৈরি করেছেন, তিনি কিছু না করেই কোটিপতি। তার ‘পৃথিবী’তে যত ‘মানুষ’, তার তত লাভ। তার পৃথিবীর বাজারমূল্য তত বেশি। তাই তিনি আমাদের ঈশ্বর থেকে আলাদা। তিনি চান অনন্ত জগতে (ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড) মানুষ তার রূপকথার রাজ্যে বসবাস করুক। তাতে তার জগতে সবাই আসতে পারবে। আবার এ অনন্ত জগতে যারা নিজেদের একান্ত জগৎ তৈরি করেছেন, তারাও চান তাদের জগৎ যেন ক্রমাগত বড় হতে থাকে। তাতে তারও লাভ। তাই দেখবেন সবাই এ জগতে বড় হতে চায়। এ জগতে পারস্পরিক সম্পর্ক কেবল বন্ধু; মা-বাবা, অন্য কিছু নয়। যারা এ জগতেও ইহজগতের মতো থাকতে চান, তারা তাদের জগতে মা-বাবাকে বন্ধু বলে নতুন সম্পর্ক তৈরি করেন। আর যারা ইহজগৎ থেকে পৃথক কোনো জগৎ সৃষ্টিতে তত্পর, তারা নিজেদের জাগতিক সম্পর্ককে উপেক্ষা করেন। বন্ধু বলে অস্বীকার করেন।
এ তো গেল আপনার সমাজ প্রতিষ্ঠার কাহিনী। কিন্তু দেখবেন এ সমাজও আপনাকে দিতে পারে বিপুল অর্থসম্পদ। আপনার এ ‘একান্ত জগৎ’ যত বড়, আপনার বাজারমূল্য তত বেশি। কিসের বাজার? আপনার অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাকে এখানে কেনাবেচা করা যায়। অর্থাৎ ঈশ্বরত্বকে আপনি বিক্রয় করতে পারেন। আপনাকে তারা ঈশ্বর বলবে না, বলবে প্রভাবক বা প্রভাবকারী। কত টাকা আপনি আয় করতে পারেন?
আপনার একান্ত জগতে ‘মানুষ’ বা অনুসারীর সংখ্যা যত বেশি, ততই আপনার বাজারমূল্য বৃদ্ধি পায়। দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার একটি তথ্য অনুযায়ী, আপনার অনন্ত জগতে যদি ১ লাখ অনুসারী থাকে, তবে আপনি ইউটিউব থেকে মিনিটে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার বা ১০ লাখ টাকা আয় করতে পারেন। আপনি যদি ফেসবুকের ঈশ্বর হয়ে থাকেন, তবে আপনি আয় করবেন মিনিটে এর অর্ধেক। আর যদি টুইটারের ঈশ্বর হোন, তবে পাবেন মিনিটে সর্বোচ্চ ২ হাজার ডলার। আপনি যদি পরমেশ্বর হতে পারেন (যখন আপনার জগতে ১০ লাখ ‘অনুসারী’ থাকবে), তখন আপনার আয় বেড়ে প্রায় ১০ গুণ হবে।
বুঝতেই পারছেন এ জগতে আপনার আসল কাজ নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। যত বড় ঈশ্বর তত আপনার মূল্য। তাই আপনি আশ্রয় নেবেন নানা অপকর্মের। অপকর্ম কেন? কারণ কর্ম ছাড়াই যখন আপনি ঈশ্বর হতে চাইছেন, তখন অপকর্মই আপনার আশ্রয় হবে। খোলাসা করে বলি, আপনি যদি ট্রাম্প কিংবা মোদি হোন, তখন আপনার কর্ম বা পরিচিতির কারণে আপনার জগতে থাকবে লাখ লাখ মানুষ, যারা আপনার কর্মের অনুসারী। কিন্তু আপনি যখন কোনো কর্মই করেননি তখন? তখন আপনার উদ্দেশ্য হবে কী করে মানুষকে আপনার জগতে আনা যায়, তার ফাঁদ তৈরি করা। অনেকটা শয়তানের মতো। আপনি তার মনোজগতে প্রবেশের দ্বার খুঁজবেন। তার প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত ইচ্ছাকে বশে আনতে চাইবেন। আপনার ইউটিউব চ্যানেলে সেই সব তথ্য সন্নিবেশিত করবেন, এমন টোপ দেবেন যেন তারা অনেকটা মধু খাওয়ার আশায় আপনার ‘বন্ধু’ হয়ে যায়। তারা প্রতিদিন অপেক্ষা করবে, আপনি তাদের সুপ্ত ইচ্ছা অনুযায়ী প্রকাশ করবেন নানা বিষয়বস্তু। তাতে তার লাভ হবে। আপনাকে অনুসরণ করলেই সে পাবে তার মুক্তি। অন্য কোথাও যেতে হবে না। আপনার নজর থাকবে সে কী চায় তার দিকে। কোন পোস্ট কত লাইক হলো, তার তথ্য বিশ্লেষণ করা আর সেই রকম তথ্য তৈরি করা। প্রতিদিন যদি তথ্য না দেন, তবে সেই ঈশ্বর ক্ষমতা হারাবেন। তাই আপনার পেশা বা নেশা হবে এ জগতে অনুপ্রবেশ করে স্থায়ীভাবে বাস করা। আপনার কাজ একটাই, আপনার অনুসারীরা যা চায়, তা তৈরি করে প্রকাশ করা। তাদের পছন্দ ও অপছন্দ নজরে রাখা।
মনোজগতে আমরা অনেকেই বাস করি রূপকথার রাজ্যে। যা জগতে করা সম্ভব না, তা এ অনন্ত জগতে পূরণ করতে চাই। তাই জাগতিক তথ্যের চেয়ে রূপকথার তথ্য এখানে বেশি হবে। আপনাকে সম্মোহিত করার জন্য তৈরি হবে রূপকথার নানা তথ্য। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মেলা তৈরি হবে এ অনন্ত জগতে। কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা, তা জানা হবে অসাধ্য। তাই বুঝতেই পারছেন এখানে তাত্ত্বিক অর্থনীতির জ্ঞান ভেস্তে যাবে। তাত্ত্বিক অর্থনীতি বলছে, প্রতিযোগিতার ফলে সঠিক তথ্য তৈরি হয়। বিতাড়িত হয় অবান্তর বা কল্পিত কথা। বাজার হয় ন্যায্য। কিন্তু এখানে আছে অসম প্রতিযোগিতা। এখানে কাজ করে গ্র্যাশাম’স ’ল, অর্থাৎ এখানে কল্পিত তথ্যের সঙ্গে প্রকৃত তথ্য পেরে ওঠে না। তাই আপনাকে হতে হবে সাবধানী। জানতে হবে অলিগলি। সেই তথ্যই গ্রহণ করবেন, যার সরবরাহকারী আপনার ঈশ্বর। যাকে আপনি চেনেন বা যে প্রতিষ্ঠান নিজেকে কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছে, গল্পের মাধ্যমে নয়; তাকেই কেবল বিশ্বাস করবেন, অন্যকে নয়।
লেখক: অর্থনীতিবিদ; ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ও এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের পরিচালক
পাঠকের মতামত