সম্পাদকীয়
ব্যাংক কাকে বলে, তা নিয়ে ভাবনার শেষ নেই। ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো শিল্প ও ব্যবসায় অর্থের জোগান দেয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক, ছয়টি রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৪১টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক (এর মধ্যে আটটি ইসলামী বাণিজ্যিক ব্যাংক), নয়টি বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংক, পাঁচটি অনির্ধারিত ব্যাংক ও ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার সঙ্গে এবার যোগ হচ্ছে আরো তিনটি নতুন ব্যাংক। এ নিয়ে সমালোচনার অভাব নেই। কেন নতুন ব্যাংক দেয়া হচ্ছে, যেখানে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকগুলোই পাচ্ছে না আমানত? কেউ কেউ বলছেন, ব্যাংক একটি ব্যবসার নাম! কেউবা বলছেন, একটি টাকা লুটের কারখানা। এসব প্রশ্নের মীমাংসা করতে না পারলেও এ লেখায় আমার লক্ষ্য থাকবে বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট করা।
কথা হচ্ছিল আমার এক অনুজ সহকর্মীর সঙ্গে। তার প্রশ্ন থেকেই লেখাটির উদ্ভব। তার প্রশ্ন, স্যার, দেশে এ মুহূর্তে তিনটি নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল কি? কিছুটা স্তম্ভিত, এ কারণে এমন প্রশ্নের তাত্ক্ষণিক উত্তর দিতে আমি তৈরি ছিলাম না। তাই পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, কেন এমন প্রশ্ন? উত্তর প্রথমত, দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকগুলোই যখন আমানত নিয়ে হাহাকার করছে, তখন নতুন ব্যাংক কী করে আমানত সংগ্রহ করবে? আর কী করেই বিনিয়োগ বাড়াবে? বরং আমাদের উচিত খারাপ ব্যাংকগুলোকে এক করে দেয়া। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগ স্থবিরতার বাইরেও রয়েছে ঋণগ্রহীতাদের ঋণ ফেরত দিতে অনীহা বা অক্ষমতা। ফলে শেষ পর্যন্ত আমানতকারীরাই তাদের আমানত হারাবেন। যুক্তি অকাট্য। তাই ভাবলাম বিনিয়োগ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৭-১৮ সালের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী এক বছরে দেশে ব্যাংকিং ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। নন-পারফর্মিং ঋণের পরিমাণ বেড়েছে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। একই রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ সালের শেষ ছয় মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের ঋণের খাতা থেকে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঋণ ‘নাই’ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। অর্থাৎ এ টাকা অফেরতযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একই সময়ে মোট অফেরতযোগ্য ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। লক্ষ করুন, অন্য সব প্রতিষ্ঠান মিলে (প্রায় ১৭টি প্রতিষ্ঠান) অফেরতযোগ্য ঋণের পরিমাণ ৩৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরলভাবে বলা যায়, যেখানে প্রতিটি বেসরকারি ব্যাংক গড়ে ৫৮ কোটি টাকার ঋণকে ছয় মাসে অফেরতযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে, সেখানে অন্যরা (সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংক, অনির্ধারিত ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবাই মিলে) গড়ে মাত্র ২০ কোটি টাকার ঋণ অফেরতযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে। আমরা সবাই জানি, এসব প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণকে বিভিন্নভাবে ভাগ করে। সব প্রথাগত ও অপ্রথাগত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেই কেবল ঘোষণা করে যে এ টাকা আর পাওয়া যাবে না এবং তা অফেরতযোগ্য বলে ঘোষণা করে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তার পরিমাণ অন্য সবার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। কেন তা হবে তা ভাবার বিষয় কিংবা বলা চলে তদন্তের দাবি রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে, একই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আরওএ (রিটার্ন অন অ্যাসেট) কমেছে, কিন্তু আরওই (রিটার্ন অন ইকুইটি) বেড়েছে। সার্বিকভাবে ২০১৮ সালে যেখানে প্রায় ৯ দশমিক ২২ শতাংশ ঋণ ক্লাসিফায়েড বা ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে ২০১৭ সালে তা ছিল ৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। তাই বলা চলে, যেখানে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমানতকারীদের আমানতে ঝুঁকির পরিমাণ বাড়ছে, সেখানে কিন্তু ব্যাংক মালিকদের বিনিয়োগের ওপর প্রদেয় লভ্যাংশের হার বাড়ছে। ব্যাংক তাই একটি নতুন ব্যবসার নাম। তাই বাংলাদেশে ব্যাংকের মালিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক মিলেমিশে একাকার! অথচ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয় ব্যবসায় তথা ব্যবসায়ীদের মূলধন জোগানোর জন্য। এ মুহূর্তে আমাদের দেশে যা হচ্ছে তা ঠিক উল্টো। এখানে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের মূলধন জোগান দিচ্ছেন। ‘ব্যাংক ব্যবসা’ এতটাই লাভজনক যে সবাই একটি করে ব্যাংকের মালিক হতে চাইছেন। এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অন্য ব্যাংক কিনে ফেলা এবং সেই ঋণকে অফেরতযোগ্য বলে ঘোষণা দেয়া এখন ডালভাতে পরিণত হয়েছে।
অবস্থা এমন যে কেবল ব্যবসায়ী নন, দেশের কেউই আর বিনিয়োগে আগ্রহী নন। তাদের আগ্রহ ব্যাংক প্রতিষ্ঠায়। ভুল না করে থাকলে আমার জানামতে এরই মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশী, পুলিশ, আনসার, বিজিবি ও সামরিক বাহিনী— সবাই এরই মধ্যে ব্যাংকের মালিক হয়েছে, বাকি রয়েছে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা সমিতি, শিক্ষক সমিতি ও বিচার বিভাগ! অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, যাদের হাতেই টাকা রয়েছে, তারাই মনে করছেন ব্যাংক হলো একটি ঝুঁকিবিহীন ব্যবসা! এখানে যেটুকুন ঝুঁকি রয়েছে, তার দায় সরকারের। কারণ সরকার শেষ পর্যন্ত আমানতকারীদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেই।
এ প্রবণতার জন্য কে দায়ী, তাও ভেবে দেখা উচিত। খোদ অর্থমন্ত্রীর মতে, দেশের মুখ্য চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ বৃদ্ধি। আমার গত লেখায় আমিও তা বলেছিলাম। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তা নয়, সবাই ব্যাংকে বিনিয়োগে আগ্রহী। এটাই কি সর্বোত্কৃষ্ট ব্যবসা? আমি অবাক হব না যদি দেখি শিল্পায়নের হার বাড়ানোর জন্য সরকার আগামীতে ব্যাংককে একটি শিল্প বলে ঘোষণা দিচ্ছে। তবে তাতে দেশের উপকার হবে না। শেষ পর্যন্ত অর্থ হারাবেন আমানতকারীরা।
একই সঙ্গে এ কথাও সত্য নয় যে ব্যাংক তার সব ঋণই ফেরত পাবে। ব্যাংকের ঋণ নিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন এমন ব্যবসায়ীও রয়েছেন। তারা সংগত কারণেই ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হবেন। একটি বর্ণনা দিই। আমাদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একজন ব্যবসায়ী গিয়েছিলেন ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে। উদ্দেশ্য ছিল সরকারের সবুজ ঋণের সুযোগ গ্রহণ করে তার শিল্প প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়ন। তাই তিনি ভাড়া করা ভবন থেকে নিজের ভবনে শিল্প স্থানান্তরে ঋণ চাইলেন। ব্যাংক জানাল, তার নিজস্ব বিনিয়োগের পরিমাণ মোট বিনিয়োগের ৩০ শতাংশ হলেই তিনি বাকি ৭০ শতাংশের জন্য ঋণ সুবিধা পাবেন। বেচারা নিজের ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করার দুই বছর পরও তার ৭০ শতাংশ ঋণ পায়নি। এ সময়ে তার সঞ্চিত অর্থেও টান পড়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক সময়মতো ঋণ না দেয়ায় তাকে সর্বস্বান্ত হতে হবে। তিনি দ্বারস্থ হচ্ছেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সময়মতো ঋণ না দেয়ায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, কিন্তু ব্যাংক আপনার পকেটে থাকলে তা হবেই না; বরং আপনার লাভ বাড়বে। তাই সবাই ব্যাংক পকেটে রাখতে চাইছেন। ফলে শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগ হবে কাগুজে। কথায় বলে, ‘কাজীর গরু খাতায় আছে গোয়ালে নাই।’ এখানেও তা-ই হবে, দেখবেন ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে। মনে হবে বিনিয়োগ হচ্ছে। আর এ ঋণের অর্থে সবাই একটি করে ব্যাংক কিনছেন! বিনিয়োগ আদতে শূন্য।
সব শেষে ক্যামেল সূচক অনুসারে ২০১৭ সালে দেশের একটি ব্যাংককে অসন্তোষজনক, সাতটি ব্যাংককে প্রান্তিক (অসন্তোষজনক), নয়টি ব্যাংককে মোটামুটি ও ৪০টি ব্যাংককে সন্তোষজনক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তা দেখে এক সহকর্মী বললেন, নতুন ব্যাংক নয়, সরকারের উচিত খারাপ ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার ব্যবস্থা করা। তাতে ব্যাংকিং খাত রক্ষা পাবে। উত্তরে বলেছি, আপনি খারাপ ব্যাংক উদ্ধার করার দায় ভালো ব্যাংকের ওপর দিতে চাইছেন। এ হিতোপদেশ আরো অধিকসংখ্যক ব্যাংককে খারাপ হতে উৎসাহিত করবে। যে নিয়মে ভালোরা পরাভূত হয় আর খারাপরা পুরস্কৃত হয়, সে নিয়ম চালু করলে ভালো আর টিকেই থাকবে না। তাই দয়া করে এ পরামর্শ দেবেন না। বহুদিন আগেই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ একারলফ তা বলে গেছেন।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট
পাঠকের মতামত