সম্পাদকীয়
চালের বাজার অস্থির। তার সঙ্গে অস্থির আমাদের সংবাদ মাধ্যম। সবার মুখে প্রায় এক শব্দ সিন্ডিকেট। অর্থাত্ তারা বলতে চাইছে যে,আড়তদাররা কারসাজি করে চালের বাজার অস্থির করে তুলছে। বিষয়টি যদি সত্যি হয়, তবে সরকারকে বেশকিছু স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাতে অস্থিরতা কমবে। আর যদি মিথ্যা হয়,তবে অস্থিরতা আরো বাড়বে। অর্থাত্ আমাদের সরকার আছে শাঁখের করাতের মধ্যে— কি সত্য কি মিথ্যা তা নির্ণয় করে সিদ্ধান্ত না নিলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। বিষয়টির এদিক ওদিক তুলে ধরার জন্য আজকের এ লেখা।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও বেশ তোড়জোড় এবং জোর করে ক্ষমতায় এসেছিল। প্রথম বছর বেশ ভালোই চলছিল। রাজনীতিকদের ঘাড়ে সব দোষ দিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতার আড়ালে থেকে রাজশাসন চালাচ্ছে। কথায় আছে, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’,অর্থাত্ বিপদে অন্যের কাঁধে দোষ চাপানোর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা কখনই হয় না। তাই সব দায় রাজনীতিবিদদের ওপর চড়িয়ে দিয়ে সরকার অতি সাবধানে গুটিকতক আমলা আর বুদ্ধিজীবী দিয়ে দেশ চালাচ্ছিল। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে রাজনীতিবিদদের নির্বাসনে দিয়ে নতুন করে সরকার গঠনের তোড়জোড় চালাচ্ছিল সরকার ও তাদের সাহায্যকারী কিছু বিদেশী কূটনীতিক। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের কল্পনাকে বাস্তবতা দিয়ে বোঝার জন্য বিদেশী কূটনীতিকরা আমাদের মতো অনেকেরই সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিলেন। আমাদের তিনজনকে (নাম উল্লেখ করলাম না) একদিন দুপুরের ডাল-ভাতের দাওয়াত দিয়ে বসলেন এক বিদেশী কূটনীতিক। তার সঙ্গে আলাপচারিতার এক ফাঁকে বুঝেছিলাম— তার আসল উদ্দেশ্য পরখ করে নেয়া তাদের তত্ত্ব মোতাবেক দেশ শাসন করা যায় কি না। গল্পের একপর্যায়ে আমাদেরই একজন বললেন, ‘দেখো, তোমাদের এখন প্রধান চিন্তা হওয়া উচিত চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা। তা না হলে তোমরা কিছুই করতে পারবে না। আর আমার মতে,তোমরা ব্যর্থ হতে যাচ্ছ। তোমরা সেদিকে নজর দাও। ‘মোদ্দাকথা, আমাদের মন্তব্য ছিল অযথা সরকারের আয়ুষ্কাল লম্বা করার চিন্তা বাদ দিয়ে তোমরা নির্বাচনের দিকে নজর দাও। ১০ জন উপদেষ্টা দিয়ে এত বড় অর্থনীতি চালাতে পারবে না। অর্থনীতি অচল হয়ে পড়বে। সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম টনপ্রতি ৪০০ ডলার ছাড়িয়েছে। মার্চে চালের দাম হয়েছিল ৬৭২ ডলার, এপ্রিলে ১০১৫ ডলার। তার পরের অবস্থা আমাদের জানা,যত দোষ নন্দ ঘোষ— সরকার চাল ব্যবসায়ীদের ওপর নজরদারি বাড়াল। চালের সিন্ডিকেটের কথা দেশের টিভির টকশো আর পত্রিকার পাতায় যতই বাড়তে লাগল, ততই চালের বাজার অস্থিতিশীল হলো। কারণ তাদের উপদেশে প্রভাবিত হয়ে সরকার ব্যবসায়ীদের ওপর নিগ্রহ বাড়িয়ে দিল। যখন বুঝতে পারল,ততদিনে চাল আমদানির সব দুয়ার বন্ধ। চাল আমদানিতে ব্যর্থ সরকার শেষ পর্যন্ত নতজানু হয়ে রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলো।
যেকোনো পণ্যের বাজারদর অনেকটা পালস রেটের মতো। বাড়লেও বিপদ,কমলেও বিপদ। বাজারে পণ্যমূল্য বাড়লে বুঝবেন চাহিদার তুলনায় জোগান অপ্রতুল। আর কমলে বুঝবেন ঠিক উল্টোটা। পণ্যের দাম অত্যধিক বাড়া যেমন সরকারের জন্য বিপদসংকেত, তেমনি একেবারে কমে গেলেও দেখবেন তা এক অশনিসংকেত। এক্ষেত্রে ওই পণ্য উত্পাদনে কেউ আগ্রহী হবে না। আর বাজার তাতে হবে আবারো অস্থিতিশীল। তাই দেখবেন বাজারে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল করার ওপর অনেক অর্থনীতিবিদ নজর দিয়ে থাকেন।
এবারে আসি কেন মূল্য ওঠানামা করে তা নিয়ে। খুব সহজ ভাষায় পণ্যমূল্য বেড়ে গেলে বুঝতে হবে তার উত্পাদনে ঘাটতি আছে। শিল্পপণ্যের ক্ষেত্রে তা তেমন সাংঘাতিক বার্তা বয়ে আনে না, তবে কৃষিপণ্যের বেলায় তা বেশ বিপজ্জনক বার্তা। কৃষিপণ্য বছরে একবার বা দুবার কেবল নির্দিষ্ট মৌসুমে উত্পাদিত হয়। তাই কৃষিপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে হলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত মজুদ। লক্ষ করবেন, না বুঝে আমরা এই মজুদকেই আক্রমণ করি। কোনো মৌসুমের উত্পাদন ব্যাহত হলেই বুঝতে পারবেন যে, মজুদে ঘাটতি হবে। এ মজুদ ঘাটতি চালের আড়তদারকে পিটিয়ে বা ভয় দেখিয়ে বাড়ানো যাবে না। প্রয়োজন হবে পর্যাপ্ত আমদানির। আর যখন একসঙ্গে অনেক দেশে উত্পাদন ঘাটতি হয়, তখন ভয় অনেক। কারণ অনেক বিক্রেতা দেশই বুঝতে পারে যে,আগামী মৌসুম আসার আগ পর্যন্ত দাম বাড়তেই থাকবে। সেক্ষেত্রে তারা দাম বাড়বে এ আশায় বিক্রি কমিয়ে দেবে। এটা স্বাভাবিক চিন্তা। যাদের ঘাটতি রয়েছে, তাদের তাই অনেক কুশলী হতে হবে। অগ্রিম চাল আমদানির ব্যবস্থা রাখতে হবে কিংবা সবাই বোঝার আগে আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। দেরিতে কাজটি করতে গেলে দেখবেন পর্যাপ্ত পরিমাণে পাবেন না।
খবরে প্রকাশ, ‘পর্যাপ্ত আমদানির পরও চালের দাম কমছে না’। এমন মন্তব্য বিশ্লেষণ করি। মনে রাখবেন, কোনো বাজারে জোগান বাড়লে দাম ধরে রাখা অসম্ভব হয়। তাই দেখবেন, নতুন মৌসুমের ফসল ওঠার পর পরই দাম পড়তে থাকে। শতচেষ্টা করেও ব্যবসায়ীরা তা ঠেকাতে পারেন না। মনে করুন, আপনি একজন ব্যবসায়ী, আপনি জানেন আগামীতে দাম আরো বাড়বে, আপনি কি করবেন? এখনই সব মজুদ বিক্রি করে দেবেন? নিশ্চয়ই না। আবার ধরুন, আপনার কাছে পণ্যের মজুদ রয়েছে কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন যে, নতুন পণ্য বাজারে উঠবে ক’দিনের মধ্যে। আপনি কি করবেন? পুরনো স্টক ধরে রাখবেন? নাকি তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দেবেন? নিশ্চয়ই বিক্রি করে দেবেন! তাহলে দেখুন,আপনার ভাগ্য অর্থাত্ মুনাফা নির্ভর করবে কত সঠিকভাবে আপনি আপনার মজুদ রাখবেন তার ওপর। এতেই আপনি সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। দোষ মজুদের নয়। কিন্তু যত দোষ নন্দ ঘোষ তত্ত্ব অনুযায়ী আপনাকে বাংলায় গালি দেয়ার জন্য মজুদদার বলা যায়। সেক্ষেত্রে সরকার বেঁচে যায়। নিজের ব্যর্থতা অন্যের ওপর চালিয়ে দেয়ার সুযোগ কোনো সরকারই হাতছাড়া করবে না। সবাই জানবে ব্যবসায়ীরাই সব কিছু করছেন। দাম বাড়ানো যেমন তাদের কারসাজি, তেমনি কমানোও। ঘটনা কিন্তু আদৌ তা নয়। মূলত বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে সরকার কোরবানির পশু খুঁজছে। মজুদদার এ রকমই এক পশু!
এবার বিষয়টা আরো একটু খোলাসা করি। চলতি বছর আমাদের বোরো ধানের উত্পাদনে ঘাটতি হয়েছে। তা ঘটেছিল মে মাসে। কিন্তু বন্যা আমাদের ছেড়ে যায়নি। আমন মৌসুমের উত্পাদনেও এখন বন্যার হাতছানি। বলা যায় না, আমনে ঘাটতি হতেও পারে। আমার জানামতে বাংলাদেশ, চীন, শ্রীলংকা, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামে এবার চালের উত্পাদন কমেছে। অন্যদিকে মিয়ানমার, ব্রাজিল, কম্বোডিয়া ও মিসরে উত্পাদন কিছুটা বেড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ,চীন,শ্রীলংকা চাল আমদানিকারক এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম চাল রফতানিকারক দেশ। বিষয়টা কোন দিকে যাবে বলে মনে করেন? আমদানির চাহিদা বাড়বে আবার রফতানির জোগান কমবে। বিশ্ববাজারে চালের দাম বাড়বে না কমবে, তা বুঝতে নিজেই অংক কষে নিন। এ অবস্থায় সরকার একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করেছে,যাতে আমদানি বাড়ানো যায়। এ-যাবত্ ২১ লাখ টন চাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে তবে তা এখনো আসেনি। সরকারের খাদ্যমন্ত্রী মিয়ানমারে গিয়েছেন চালের আশায়, ১০ লাখ টন চাহিদার স্থলে পেয়েছেন মাত্র তিন লাখ টন। প্রশ্ন হতে পারে, তবুও দাম কমছে না কেন? উত্তর সহজ, যে পরিমাণ ঘাটতি ব্যবসায়ীরা অনুমান করছেন, আমদানির পরিমাণ তার তুলনায় হয়েছে যত্সামান্য। আশির দশকে বাংলাদেশ ছিল চতুর্থ বৃহত্তম চাল উত্পাদনকারী দেশ,এখন ষষ্ঠতম। চলতি বছর আমাদের কেবল বোরো ফসলেই ঘাটতি হয়েছে প্রায় সাত লাখ টন। আমনের অবস্থা এখনো অজানা। চাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে তবে আমদানির পরিমাণ খুব আশাব্যঞ্জক নয়। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের একটি উদাহরণ দিই। ঋণপত্র যা খোলা হয়েছে, তার মাত্র ৫৬ শতাংশ আমদানি হয়েছে। একই সময়ে গম আমদানি হয়েছে ঋণপত্রের ৮০ শতাংশ। বুঝতেই পারছেন,চাল আমদানির অবস্থা গমের তুলনায় কম। বিশ্ববাজারে চালের দাম জুলাইয়ে বেড়েছে ১১ শতাংশ অথচ গত বছর একই সময়ে তা বেড়েছিল ৩ শতাংশ। অর্থাত্ চাহিদার চাপ বাজারে বিদ্যমান। এমতাবস্থায় সংবাদ মাধ্যমে ব্যপকভাবে প্রচার পাচ্ছে চালের সিন্ডিকেট তত্ত্ব। আর তার ফলে ব্যবসায়ীরা শিগগিরই আবার কোরবানির পশুতে পরিণত হবেন বলে অনেকেই অনুমান করেন। একদিকে চালে দাম বাড়ছে, মজুদ কমছে। অন্যদিকে বাড়তি দামে বিক্রি করতে গিয়ে সরকারের রোষানলে পরিণত হবে— এমন অবস্থায় কেউ কি আমদানিতে উত্সাহিত হবে? নিশ্চয় না। ঋণপত্র খোলা হবে তবে আমদানি হবে আরো শ্লথগতিতে। তার ওপর দাম বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকলে আমদানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না। চালের বাজারে আগুন লাগবে।
আগস্টের প্রথম ১৫ দিনে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৩৭.১৬ মিলিয়ন ডলারের আর সরকারি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ০.০৭ মিলিয়ন ডলারের। ব্যর্থতা চোখে দেখার মতো। এ-যাবত্ চালের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, চীন, ইরান, ইরাক, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব অধিক আমদানির আভাস দিয়েছে। আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে কেবল ইন্দোনেশিয়া আমদানি কমাবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ফলে চালের দাম যে বাড়বে, তা স্পষ্ট। এটুকু উপলব্ধি করে চালের বাজারে আগুন না দিয়ে পানি ঢালার ব্যবস্থা করা সরকারের জন্য মঙ্গলজনক হবে। সরকারের উচিত, দেশের অভ্যন্তরের চাল সংগ্রহ করার পরিবর্তে পর্যাপ্ত আমদানির ব্যবস্থা করা। এবং তা যত শিগগির হবে,ততই দেশ ও সরকার উপকৃত হবে। তবে সে সরকারি চাল যেন আবারো গো-খাদ্যে পরিণত না হয়, সে বিষয়ে দৃষ্টি দেয়াও জরুরি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক
অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট
পাঠকের মতামত