সম্পাদকীয়
বছর আসে বছর যায়। বছরের শুরুতে আমাদের অনেকেই মানত করেন, বছরটি যেন ভালো যায়, নিজের উন্নতি হয়, দেশের উন্নতি হয়। তবে কোন বছর, কার বছর, কবে শুরু তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাঙালিদের বছর গণনা শুরু হয় ১ বৈশাখ থেকে, সঙ্গে থাকে ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকা। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে শুরু হয় আমাদের একদিন আগে, তাদের ভাষায় সংক্রান আর আমাদের চৈত্রসংক্রান্তি থেকে। খ্রিস্টানদের শুরু হয় ১ জানুয়ারি থেকে, আরবদের শুরু হয় ১ মহররমে। আর বাংলাদেশ সরকারের নববর্ষ শুরু হয় ১ জুলাই থেকে। অর্থাৎ নববর্ষ নানা জনের নানা দিনে। এই দিন পৃথিবীর মানুষের জন্য একই দিনে হয় না। অতএব বিষয়টি নিয়ে অতিমাত্রায় আবেগী হওয়ার কোনো কারণ নেই আমাদের মনুষ্যসমাজের। এ দিনটি আর ১০টি দিনের চেয়ে পৃথক নয়। জীবন শুরু হয় জন্ম থেকে, আর সংসার শুরু হয় বিয়ে থেকে। মূলকথা, গণনার শুরু কবে তা জানা।
আমার মতে, ২০১৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল ট্রাম্পের চীনবিরোধী বাণিজ্যনীতি। ঘটনাটির বিশেষত্ব ক্রমে বিকশিত হবে ২০১৯ থেকে। এরই মধ্যে চীনের অর্থনীতিতে ছাপ পড়তে শুরু করেছে। তাদের শিল্পে মোট মুনাফার পরিমাণ কমেছে। মার্কিন মুলুকেও প্রভাব স্পষ্ট। তাই আগামী বছরটি হবে বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। অনেকদিন পর পৃথিবীর আকাশে আবারো মন্দার পূর্বাভাস দেখা দিচ্ছে, যার মূলে রয়েছে ট্রাম্পের চীনবিরোধী নীতি। ২০০৮ সালে মন্দা থেকে বিশ্বকে রক্ষা করেছিল চীন, কিন্তু এবার?
অন্যদিকে ২০১৯ সালে অন্তত মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক কর্তৃত্বের সমাপ্তির শুরু হতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন। এ আধিপত্যের শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালে মিসর থেকে। কাকতালীয়ভাবে ১৯৭২ সালেই ভিয়েতনামে মার্কিন কর্তৃত্ব শেষ হয়েছিল। তাই এবার মধ্যপ্রাচ্যের পর কোথায় মার্কিন সামরিক বহর যাবে তা নিয়ে আমাদের ভাবনা থেকেই যাবে। মেক্সিকো, নাকি আফ্রিকা বা এশিয়ার কোনো দেশ? তা নিয়ে সাবধান বিশ্ববাসী! বিশাল সামরিক শক্তি নীরব থাকবে না।
এই যখন বিশ্বের অবস্থা তখন আমাদের কী হবে তা নিয়ে ভাবছেন? বাড়ি থেকে যখন বের হন তখন মৃত্যু আমাদের হাতছানি দেয়, তাই বলে কি আমরা চুপ করে নন্দলালের মতন বসে থাকি? নিশ্চয়ই না। আমরা সাবধানে পা ফেলি। প্রথমে বামে তারপর ডানে, তারপর আবারো বামে চোখ রেখে রাস্তা পার হই। তেমনি অর্থনীতিও একইভাবে চলে। চারদিকে চোখ রেখে আমাদের পা ফেলা জরুরি। তার জন্য প্রয়োজন তথ্য ও উপাত্ত। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের চেয়ে এর ওপর নজর রাখা অত্যন্ত জরুরি। সবসময়ই কি তথ্য-উপাত্ত লাগে? অনেকেই তা মনে করেন না। তাই মনগড়া তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আপন ভুবন তৈরি করে রাখেন।
একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। মনে করুন আপনি রাস্তা পারাপারের নিয়মটি জানেন। রাস্তা পারাপারে প্রথমে বামে তারপর ডানে, তারপর বামে তাকাবেন। কেন? তাত্ক্ষণিক উপাত্ত সংগ্রহ করতে। দেখছেন কোনো দ্রুতগতির গাড়ি আসছে কিনা যেন সাবধান হতে পারেন। এবার মনে করুন আপনি বান্দরবনের কোনো উপজেলায় রাস্তা পার হচ্ছেন, আপনি কি এ নিয়মমতো রাস্তা পারাপারের যৌক্তিকতা খুঁজে পাবেন? না, তা পাবেন না। অর্থাৎ শহরের গতি দ্রুত, শব্দ যন্ত্রণা প্রকট, উপাত্ত সংগ্রহে চোখের প্রয়োজন। নিয়মটি তাই শহরেই প্রয়োজন। সেখানে কী করবেন? কান পেতে চোখ বন্ধ করে রাস্তা পার হবেন। কারণ? সেখানে আপনার শ্রবণশক্তিই জানান দেবে গাড়ি আসছে কিনা। তেমনি অর্থনীতিতেও; অর্থনীতি যখন ছোট, আয় যেখানে গ্রামনির্ভর তখন ধানের দিকে তাকিয়েই বলবেন, এবার ফলন ভালো হয়েছে, দেশের দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু অর্থনীতি যখন বড় এবং উৎপাদনের চেয়ে যখন সেবাই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তখন? তখন কিন্তু কেবল ধান দেখেই অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা করাটা হবে বোকামি। তাই আমাদের প্রয়োজন তথ্য-উপাত্তের এবং তা বিশ্লেষণের। আগামী দিনে তাই আমাদের হতে হবে বিশ্লেষণধর্মী।
এবার আসুন ২০১৮ সালের কিছু উপাত্ত জেনে নিই। গত নভেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসিক প্রতিবেদন থেকে যে তথ্য পাওয়া যায়, তার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২০১৮ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে আমাদের রফতানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই তাতে আমাদের আমদানিতে প্রভাব পড়বে। একই সময়ে আমাদের আমদানি বেড়েছে ২৪ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে। আরো রয়েছে শিল্পের বিশেষত পোশাক শিল্পের কাঁচামাল। অন্যান্য আমদানির মধ্যে কেবল চিনি ছাড়া গত নয় মাসে প্রায় সব আমদানিই বেড়েছে। তবে সর্বোচ্চ হয়েছে পেট্রল বা পেট্রলজাতীয় পণ্য আমদানি, যার পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা অথবা ৬৬ শতাংশ। আমদানির চেয়ে রফতানি কম বৃদ্ধির ফলে আমাদের সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রা তহবিল থেকে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। একই সময়ে বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ২৩ শতাংশ বা ২০ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক গতি পরিমাপ করা হয় জিডিপির মাধ্যমে। এর মূল কারণ জিডিপির গতি যত বাড়বে ততই অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। গত ১০ বছরে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি সবসময়ই ৬ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি ছিল। গত অর্থবছরে আমাদের জিডিপির গতি ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। আর এ অর্থবছরে তা বেড়ে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অর্থে শুধু এক বছরে আমাদের আগামী অর্থবছরে ১ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার নতুন উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ বলা চলে, এ নতুন উৎপাদনের জন্য নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। কী ধরনের কর্মসংস্থান হয়েছে তা এখানে বিবেচ্য হয় না। এবার আসুন কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান দেখি। ২০১৬-১৭ সালে শ্রম পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছর প্রায় ১৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। বুঝতেই পারছেন উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়ছে। বলতে পারেন অর্থনৈতিক পরিভাষা অনুযায়ী জিডিপি বাড়ছে, তাই কর্মসংস্থান বাড়ছে। আমাদের যাত্রা সমৃদ্ধির পথে।
আরেকটি চিত্র দিই। কিছুদিন আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্স পরীক্ষার মৌখিক পরীক্ষায় বসেছিলাম। একে একে যতগুলো ছাত্রছাত্রী এসেছিল, তাদের প্রায় প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের অনার্স পরীক্ষার চেয়ে মাস্টার্স পরীক্ষা অতটা ভালো হয়নি কেন? স্যার, বিসিএস পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছি। অর্থাৎ অনার্স পরীক্ষার পর তাদের আগ্রহ আর পড়াশোনায় থাকেনি। সবাই সরকারি চাকরির খোঁজে আছে। কী জন্য? ভাবলাম শ্রম পরিসংখ্যানটি কী বলে জানা যাক। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ২০১৬-১৭ সালে শ্রম পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৩ সালে যুব কর্মজীবীর সংখ্যা (১৫-২৯ বছর বয়সী কর্মজীবী) ছিল ২ কোটি ৩৪ লাখ, ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৮ লাখ আর ২০১৭ সালে তা ছিল ২ কোটি ১ লাখ। ভাবলাম তাহলে কী করে আমাদের এ প্রবৃদ্ধি হলো? শ্রম পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সালে যেখানে মোট শ্রমজীবীর সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৫৬ লাখ, ২০১৭ সালে তা হয়েছে ৪ কোটি ৫৫ লাখ! আশ্চর্য আমাদের জিডিপির তথ্য তাহলে কি ভুল?
বুঝতেই পারছেন আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর আমাদের শ্রমবাজারের চিত্র এক কথা বলছে না। বিষয়টি ক্রমে প্রকট আকার ধারণ করার আগেই আমাদের উচিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যথায় এ কর্মহীন প্রবৃদ্ধি সরকারের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে আগামী পাঁচ বছরে। গত বছরের ছাত্র আন্দোলন আর এ পরিসংখ্যান আমাদের সেই চিত্রই দেয়।
অতএব আমাদের কী করা উচিত? গত কয়েকটি লেখায় আমি দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেছি, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। শিক্ষার উদ্দেশ্য মানবসম্পদ তৈরি করা, সার্টিফিকেট তৈরি করা নয়। গতানুগতিক চিন্তা তা করতে পারবে না। তবে তা করতে সময় লাগবে আর পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। আগামী কয়েক বছরে আমাদের কী করা প্রয়োজন? সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত আমাদের বর্তমান উন্নয়ন মেগা প্রকল্পভিত্তিক। ভেবে দেখুন, পদ্মা সেতু কিংবা মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কতজনকে চাকরি দেবে? অত্যন্ত সামান্য। তাহলে আমাদের করণীয় কী? আমাদের প্রয়োজন প্রতিদিন ছয় হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টি করা— প্রমোশন দিয়ে নয়, বদলি করে নয়, প্রেষণে নয়। বুঝতেই পারছেন, সরকারের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন ব্যক্তিগত বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা। যতদিন পর্যন্ত ব্যক্তিগত বিনিয়োগের গতি শ্লথ থাকবে, ততদিন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি কষ্টকর হবে। সরকারের উচিত ব্যক্তিগত বিনিয়োগ উৎসাহিত করার স্বার্থে নিয়মনীতির প্রয়োজনীয় সংশোধন করা। আমাদের নিয়মনীতি যতটা না তৈরি হয় বিদেশীদের স্বার্থে, তার চেয়ে কম করা হয় দেশের প্রয়োজনে।
আরো একটি পরিসংখ্যান দিয়ে শেষ করি, ২০১৩ সালে অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী দেখা যায়, দেশে প্রায় ৭৯ লাখ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৫৭ শতাংশের কোনো স্থায়ী ঠিকানা রয়েছে। অন্যদিকে ৭৯ লাখ প্রতিষ্ঠানের দোকান বা মেকানিকজাতীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪৬ শতাংশ, হোটেল বা রেস্টুরেন্টজাতীয় প্রতিষ্ঠান ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, যাতায়াত ও গুদামজাত প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৭ শতাংশ, ১১ শতাংশ শিল্পজাতীয়, ১ শতাংশ স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা প্রতিষ্ঠান, ২ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শুমারি অনুসারে গড়ে একটি প্রতিষ্ঠানে তিনটি চাকরি সৃষ্টি হয়। ভেবে দেখুন, প্রতিদিন আমাদের কয়টি নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা উচিত?
এবার আপনার সন্তানকে জিজ্ঞেস করুন কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চায়? এরপর চেয়ে দেখুন প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান বিন্যাস। দেখবেন তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান বিন্যাস সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই বিনিয়োগে সব বাধা দূর করা হবে নতুন সরকারের প্রথম কাজ। প্রয়োজন হবে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে সব বাধা দূর করা। তবেই আমরা আমাদের সমৃদ্ধির ফসল ঘরে তুলতে পারব।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ও এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের পরিচালক
পাঠকের মতামত