ধারণা হয়েছিল পেঁয়াজ সমস্যার সমাধান
হয়ে গেছে। ভুল ভাঙল সেমিনারে গিয়ে। অনেকেই নানা ছলে পেঁয়াজ সম্পর্কে তির্যক
মন্তব্য করছিলেন। এর মধ্যে দুপুরে খাওয়ার সময় দেখা গেল একজনের পাতে বেশকিছু
পেঁয়াজ। কী ব্যাপার? সালাদে দেয়া নানা সবজি ছিল,
তবে পেঁয়াজটিই দামি দেখে ওগুলোই বেছে বেছে
নিয়েছি! সবাই হাসলাম। তবে বিষয়টির গুরুত্ব আমাদের কারো কাছে অজানা নয়। সমাধানের
সব প্রচেষ্টা প্রায় ব্যর্থ হয়েছে। তাই অনেকেই ভাবছেন দৃষ্টি সরাতে অন্য সামগ্রীতেও
কারসাজি (!) হচ্ছে। পেঁয়াজের ঝাঁজ আসছে চালসহ আরো অনেক কৃষিপণ্যের বাজারে। বিষয়টির
অর্থনীতি খোলাসা করার জন্য লিখছি।
পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে
সবার উপরে আছে চীন, তার উৎপাদন ২ কোটি ৪০ লাখ টন। ভারত দ্বিতীয়, তার
উৎপাদন ২ কোটি ২০ লাখ টন। ভারত প্রায় ১০ লাখ টন রফতানি করে। তবে এ বছর ভারতের
অবস্থা ভিন্ন। লম্বা বর্ষায় ভারতের মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানা প্রদেশে পেঁয়াজ
উৎপাদনে ঘাটতি হয়েছে। আর তাই মোদি সরকার সেপ্টেম্বরে তার দেশ থেকে পেঁয়াজ রফতানি
নিষিদ্ধ করেছে। বিষয়টি অবাক করার মতো নয়। কারণ পেঁয়াজের সঙ্গে ভারতের সরকার বদলের
ইতিহাস রয়েছে। সেই ১৯৭৯ সালে পেঁয়াজের দাম বাড়ার পর ভারতীয় জনগণ শেষ পর্যন্ত
ইন্দিরা গান্ধীকে পুনরায় ক্ষমতায় এনেছিল। পেঁয়াজের দাম সামলাতে ব্যর্থতার পরই
ভারতে কংগ্রেস ২০০৪ সালে আবারো ক্ষমতায় এসেছিল। তাই ২০১৯ সালে পেঁয়াজের দাম বেড়ে
যাওয়ায় মোদির ঘাম যে বেড়েছে তা বলা বাহুল্য। অতএব, তিনি পেঁয়াজ রফতানিতে বাধা দিয়েছেন।
বিষয়টি অবাক করার মতো নয়।
বিবিসির তথ্যমতে, ভারতে
কোনো কোনো রাষ্ট্রে পেঁয়াজের ট্রাক লুট হয়েছে। হাহাকার এতটাই প্রকট যে অনেক
রেস্টুরেন্ট পেঁয়াজের দোসা তাদের নিয়মিত মেনু থেকে তুলে নিয়েছে। এমন ঘটনাও শোনা
গেছে যে দোকানে চোর এসে নাকি কেবল পেঁয়াজের বস্তা নিয়ে গেছে!
বাংলাদেশ বছরে ১৮ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন
করে। তাই ভারত যখন পেঁয়াজ রফতানিতে বাধা দিল,
তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বাজারে পেঁয়াজের দাম
বেড়েছে। আমার ধারণা, বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়। আমাদের বার্ষিক আমদানি প্রায় পাঁচ-ছয় লাখ টন এবং
প্রায় সবটাই আসে ভারত থেকে। প্রশ্ন করতে পারেন, আমরা কী করতে পারতাম? পেঁয়াজ
আর কে কে রফতানি করে? পাকিস্তান রফতানি করে প্রায় তিন লাখ টন। তুরস্কের রফতানি মাত্র ৫০
হাজার টন। ইন্দোনেশিয়ার রফতানি পাঁচ হাজার টন। মিসরের রফতানি সাড়ে চার লাখ টন।
থাইল্যান্ডের রফতানি ১৫ হাজার টন। মিয়ানমারের চার হাজার টন। চীনের রফতানি সাড়ে ছয়
লাখ টন। এই সবই ২০১৮ সালের হিসাব।
অতএব, বুঝতেই পারছেন পেঁয়াজ আমদানির জন্য
আমাদের ভারত নির্ভরতা স্বাভাবিক। ভারতের রফতানিকারকরা এরই মধ্যে বলেছেন, পেঁয়াজ
রফতানিতে বাধা দেয়ায় ভারত তার রফতানি বাজার
(প্রধানত বাংলাদেশ) হারাতে পারে। আগামীতে আমরা পাকিস্তান
বা চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করতে পারি। তবে তাতে আমাদের বাজারে দাম
বাড়বে। বলতে পারেন, আমাদের পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে কি? আমাদের
দেশে কেবল নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য প্রতি বছর ৮০ হাজার হেক্টর জমি
কৃষিজমি থেকে চলে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় পেঁয়াজের আবাদ বাড়ানোর জন্য জমির পরিমাণ
বাড়াতে হলে দেখা যাবে তা নিতে হবে কৃষির অন্য ফসল থেকে কিংবা বলতে পারেন বোরো ফসলি
জমি থেকে। তাও সম্ভবত বেশ বিপজ্জনক হবে। অতএব, আমাদের সাবধানী হতে হবে। শীতকাল
পেঁয়াজ উৎপাদনের সময়। এ সময় শাকসবজিসহ বিভিন্ন প্রকার রবি ফসলের জন্যও প্রচুর জমির
প্রয়োজন হয়।
এই যখন অবস্থা, তখন
পেঁয়াজের দাম নিয়ে আমাদের উত্কণ্ঠার পাশাপাশি চিন্তা করা দরকার কী পদক্ষেপ নেয়া
উচিত? বুঝতেই পারছেন পেঁয়াজে আমাদের স্বাবলম্বী হওয়া সহজ হবে না। তবে
পেঁয়াজের বাজারের অস্থিরতা থামানোর উপায় কী?
এটিও দেখতে পাচ্ছেন যে পুলিশ, র্যাব
কিংবা অন্য কোনো বাহিনীর চোখ রাঙানিতে কাজ হচ্ছে না। বরং উল্টো হচ্ছে। পেঁয়াজ
পচনশীল দ্রব্য। তাই কোনো আমদানিকারক বছরের শুরুতে তা আমদানি করবেন না। আবার আমদানি
করলেও বেশিদিন রাখতে পারবেন না। পুলিশি কায়দায় পেঁয়াজ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নিলে পেঁয়াজ বাজারে আসবে না,
বরং পচবে। ঘটনাদৃষ্টে তা-ই হয়েছে। অবাক
হওয়ার কোনো কারণ নেই। যখনই আপনি বাজারে বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হবেন, তখন
বিষয়টি গোলমেলে ঠেকবে। ভুলে যাবেন না যে বিক্রেতারা বাজারের আসল খবর জানেন। আপনি, আমি
সবটুকুন জানি না। তারা জানেন যে আমাদের আমদানি হয়নি। আমদানির মাস ছিল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে
মার্চ পর্যন্ত। আর ঠিক সেপ্টেম্বরেই আমাদের প্রতিবেশী দেশ রফতানি বন্ধ করে দেয়।
পাকিস্তান হলো পরবর্তী দেশ। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত
নাজুক। অবস্থা এমন যে পাকিস্তানিরা আমাদের দেশে ব্যবসা করতে এলে প্রথমে পুলিশের
দরবারে হাজিরা দিতে হয়। বাংলাদেশীদেরও তা-ই। পাকিস্তানে গেলে পুলিশের খাতায় হাজিরা দিতে সময় চলে যায়। এ অবস্থায়
বাণিজ্যিক সম্পর্কে চিড় ধরেছে। চট করে পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানির সম্ভাবনা
ব্যক্তি খাতে সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না। যতদিন বাংলাদেশ-পাকিস্তান
সম্পর্ক সহজ না হবে, ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তান আমাদের আমদানিকারকের পছন্দের দেশ হবে না।
আমাদের দ্বিতীয় সুযোগ ছিল চীন। এ বছর চীনেও বর্ষার প্রকোপ ছিল। চীনে সারা বছর
পেঁয়াজ উৎপাদন হলেও তার মৌসুম মূলত নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত হয়। অর্থাৎ
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানি সম্ভব হতো না।
প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে
এখন কেন আমদানি হচ্ছে না? আমাদের আমদানির মূল সময় হলো জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত। অতঃপর আমাদের
পেঁয়াজ বাজারে আসবে। তাই পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আমদানি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা
করতে হবে। এবার একবার তাকান আমাদের কর্মকাণ্ডের দিকে। কারো কাছে পেঁয়াজ মজুদ থাকলে
আমরা তাকে অপদস্থ করতে রাজি। কতদিনের মজুদ?
কী পরিমাণ মজুদ? যেখানে মাসে আমাদের আমদানির পরিমাণ
৩০-৩৫ মিলিয়ন ডলারের পেঁয়াজ বা এক লাখ থেকে দেড় লাখ টন পেঁয়াজ। সেখানে গত কয়েক
মাসে ৬০-৭০ হাজার টন পেঁয়াজের আমদানি দেশের পেঁয়াজ বাজারকে শান্ত করতে যে পারবে না, তা
বলা বাহুল্য। ক্রেতারা তা না জানলেও ব্যবসায়ীরা জানেন। আর এর ওপর যদি মজুদদারির
অভিযোগে পেঁয়াজ বিক্রেতাদের ওপর চড়াও হই,
তবে কে-ইবা তা বাজারে আনবে?
অর্থাৎ বাজারে ঘাটতি থাকা অবস্থায় বিক্রেতাদের
ওপর চড়াও হওয়া বুদ্ধিমান সরকারের কাজ নয়।
এ অবস্থায় বাজারে আসছে দেশী পেঁয়াজ।
খুশির কথা বলে হাসবেন না। বিপদ আরো ঘনীভূত হবে। কারণ ছোট পেঁয়াজ এখনই বাজারে চলে
আসায় আগামী মৌসুমে আমাদের পেঁয়াজ উৎপাদন কমে যাবে। তাতে পেঁয়াজ সমস্যা আরো লম্বা
হবে বলেই আমার ধারণা। আমাদের পেঁয়াজ আমদানি আগামী বছরে বাড়াতে হবে। বিষয়টি ভেবে
রাখার জন্য আবেদন করব।
সব শেষে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা
কেন্দ্রে ‘বর্ষার পেঁয়াজ’ বলে নতুন পেঁয়াজবীজ উৎপাদন হয়েছিল বলে শুনেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগেই।
কিন্তু তা বাজারে আসেনি। কারণ চাষীরা পর্যাপ্ত দাম পান না বলে তাতে উৎসাহী হন না।
কৃষি অর্থনীতির কয়েকটি মূলমন্ত্রের কথা জেনে রাখা ভালো। কৃষিপণ্যের দামে কিংবা উৎপাদনে
অনিশ্চয়তা থাকলে চাষীরা সাধারণত সেসব পণ্য উৎপাদনে উৎসাহী হন না। কৃষি গবেষণা উৎপাদন
অনিশ্চয়তা কমাতে পারলেও দামের অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। বিক্রেতাদের ওপর পুলিশি
তত্পরতা বাজারে অনিশ্চয়তা বরং বাড়িয়ে দেয়। তাই অধিক পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদন কিংবা
অধিক আমদানি কোনোটাই সম্ভব হবে না। আর সরকারে বা তাদের দলীয় ব্যবসায়ীদের এক প্লেট-দুই প্লেট (!) করে
খুচরা লোক দেখানো আমদানি বাজারকে আরো অস্থির করবে। আশা করি, বিষয়টি
ভেবে দেখবেন।
ড. এ. কে. এনামুল হক: অর্থনীতিবিদ
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক
এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের
পরিচালক