করোনাভাইরাসে বিশ্বের অর্থনীতি জর্জরিত। অনিশ্চয়তা অনেক। পৃথিবীর বহু দেশে শিল্পাঞ্চল কার্যত বন্ধ। ট্রাম্প ট্রিলিয়ন ডলারের সহায়তা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। নিজ ঘরে বন্দি থাকা কোটি কোটি লোকের অনেকেরই বেতন-ভাতা বন্ধ। তাদের সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। হোটেল কিংবা প্রমোদাঞ্চল পুরোপুরি বন্ধ। চীনের অভিজ্ঞতা বলে ভাইরাস অন্তত দুই মাস সব কার্যক্রম স্তব্ধ করে দেয়। দুই মাস কম সময় নয়। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেবে। এমতাবস্থায় সব দেশের অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে গেলে খেটে খাওয়া মানুষের সাময়িক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। যারা দিন আনে দিন খায়, যাদের আয় প্রতিদিনে আপনার আসা-যাওয়ার পথে হয়—কোথাও ফুল বিক্রয় করে, কোথাও চাবি গোছা বিক্রয় করে, কারো আয় বাসের চালক বা হেলপার হিসেবে বা রিকশা বা পাঠাও চালিয়ে তাদের আয় আর রইল না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কী ভাবনা, তা নিয়েই আজকের লেখা।
আমাদের দেশে এখনো অবস্থা প্রকট নয়। কিন্তু অন্যান্য দেশের তথ্য-উপাত্ত দেখলে বোঝা যায়, অবস্থা আরো খারাপ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এখনো লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি। এরই মধ্যে প্রবাসীদের নিজ গৃহে বন্দি থাকার নির্দেশনা কার্যকর হয়নি। সেদিন গিয়েছিলাম যশোরে। আমার পাশের সিটে এক ব্যক্তির লাগেজ অনেক বেশি দেখে কিছুটা উত্সুক হয়েই দেখলাম তিনি সিঙ্গাপুর থেকে এসেছেন। যশোর বিমানবন্দরে নেমে আমরা যখন অপেক্ষা করছিলাম লাগেজের, তখন আমাদের পাশে তিনিও। রীতিমতো সুস্থ মানুষ। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, তার পক্ষে কি পরিবার হতে আলাদা বাস করা সম্ভব হবে? ততক্ষণে তিনি মোবাইলে কথা বলছেন। শুনলাম, ‘... কে
পাঠিয়ে দাও’। কয়েক মিনিট পর একটি পাঁচ-ছয় বছরের শিশু গেটের ভেতরে চলে এল। বুঝতে পারলাম ছেলেটি গেটের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। তিনি তর সইতে পারছিলেন না, তাই বলেছেন গেটের ভেতরে পাঠিয়ে দাও। কোলে তুলে শিশুকে আদরে আদরে ভরে দিলেন পিতা। কতদিন পর এসেছেন। এই যখন আমাদের পারিবারিক বন্ধন, তখন পরিবারের যে কারো অসুস্থতা দেখা দিলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। এ পর্যন্ত যে ১৭ জন কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের হিসাব দেখলে আমার এ ঘটনার সঙ্গে তার মিল পাবেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো বিপদের। ইতালিফেরত এক ভদ্রলোক কিডনিবিষয়ক যন্ত্রণায় ঢাকার একটি হাসপাতালে এসেছেন। তার চিকিৎসায় জড়িত কাউকে বলেননি তিনি ইতালিফেরত ‘কোয়ারেন্টিনে’ থাকা একজন। কিছুদিন পর ঢাকার এ হাসপাতালের চারজনের করোনার লক্ষণ দেখা দিল। বুঝতেই পারছেন সূত্র কোথায়? তার লুকোচুরি বক্তব্য আমাদের আরো বিপদে ফেলবে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে রেফারেল ব্যবস্থা একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। আপনার পাড়ার চিকিৎসক আপনাকে বড় ডাক্তারের কাছে পাঠাবে। এটাই চিরায়ত নিয়ম। আমরা তা করি না। রেফারেন্স ছাড়াই চিকিৎসা নিতে গিয়ে গোটা হাসপাতালকে বিপদে ফেলছি।
তৃতীয় ঘটনা শুনেছি ছেলের কাছ থেকে—কোনো এক মেডিকেল কলেজের এক ছাত্র পেটের ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এলে তাকে ভয়ে কেউ চিকিৎসা দেয়নি। ডাক্তারি পেশার মূলমন্ত্র রোগীর সেবা না মেনে তারা নিজেদের রক্ষা করেছেন আর সেই ছাত্র বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছে।
এই যখন অবস্থা, তখন আমি ভাবলাম—এখন অসুস্থতাও বিপজ্জনক। যেকোনো অসুস্থতায় চিকিৎসা পাওয়া দুষ্কর হবে। লন্ডনে আমার এক ডাক্তার ভাই জানাল, সেখানে এখন সব সার্জারি বন্ধ। এমনকি হার্টের রোগীদের জন্যও। আমার বাসার কাজের বুয়া জানাল, সর্দি-কাশির জন্য ডাক্তার এখন রোগী দেখতে রাজি নন। কী করা যায়? আমার নিজের শুষ্ক কাশি প্রায় ১৫ দিন ধরে। আমার ডাক্তারকে হোয়াটসঅ্যাপে জিজ্ঞাসা করে ওষুধ পেলাম। বাঁচলাম। কিছুদিন আগে রবির ডাক্তার সেবাটি কিনেছিলাম। তারা বলেছিল, দিনে আড়াই টাকার বিনিময়ে তারা যেকোনো সময় ডাক্তারের সেবা দেবে। ভাবলাম, দেখি কাজ করে কিনা! কল করলাম। অন্য প্রান্তের গলা বেশ মিষ্টি—বলল, আমাদের আজ প্রচুর চাপ, তবে আপনাকে কিছুক্ষণ পর ডাক্তার কল করবেন। বুঝলাম অনলাইন ডাক্তারের সেবা কেবল আমিই চাচ্ছি না। দেখা যাক কী হয়? কিছুক্ষণ পর কল এল। ডাক্তার সাহেব মনোযোগসহকারে সব শুনে ওষুধ দিলেন।
গল্পটি বললাম এ কারণে যে, করোনা আমাদের বদলে দেবে। আজ সকালেই আমাদের এক সহকর্মীর ই-মেইল দেখলাম। তিনি ভিডিও ক্লাস নেয়ার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। সাধারণভাবে তার সঙ্গে আমি একমত। আগামী দুই মাসের মধ্যে অবস্থার পূর্ণ উন্নয়ন হবে না, তাই আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে হলে ভিডিও ক্লাসের বিকল্প নেই। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তা শুরু করেছে। কোয়ারেন্টিনে থাকা আমাদের শিক্ষার্থীরাও নিশ্চয় বাসায় বসে বসে ত্যক্তবিরক্ত। তাই উদ্যোগটি মন্দ নয়। ভাবলাম, এমন কি সফটওয়্যার আছে, যা আমার ক্লাসের পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তখনই মোবাইলের কোনে দেখলাম যুম নামের একটি বিজ্ঞাপন। কতখানি বুদ্ধিমান হলে এরা ঠিক এমন সময় আপনাকে এমন একটি বিজ্ঞাপন পাঠাতে পারে, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
দেখলাম, এই সফটওয়্যারে আমি ক্লাসরুম পাব। কথা বলতে পারব। অন্যদের কথা শুনতে পারব। সবাই একসঙ্গে চিত্কার করতে পারবে না। ক্লাস শিক্ষকের মতন যাকে বলব, সেই-ই কেবল কথা বলতে পারবে, অন্যরা পারবে না। ছাত্ররা হাত তুলতে পারবে। আমি হোয়াইট বোর্ডে লিখতে পারব। সবই সম্ভব! তার মানে ক্লাস আমি বাসায় বসেই করতে পারব। গত মাসে আমি আমার দুটি ক্লাসের পরীক্ষা অনলাইনে নিয়েছিলাম পরীক্ষামূলকভাবে। অতএব, ক্লাস ও পরীক্ষা দুটোই সম্ভব। এরই মধ্যে ফেসবুক ওয়ার্কপ্লেস বলে একটি নতুন অ্যাপ চালু করেছে, যার মাধ্যমে বাড়িতে বসে অফিস করা যাবে।
চীনের উহানে লকডাউনের বিবরণ দেখার মতো। তারা লকডাউনের এক মাসে খাবার ডেলিভারি, ওষুধ বিতরণসহ সব কার্যক্রম চালিয়েছে অনলাইনে আর সঙ্গে পাঠাও জাতীয় ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির সহায়তায়। আরো আছে, সব সেবামূলক কাজ করে যারা বেঁচে থাকেন—তাদের সবাই কিছু না কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে চলবে কৃষি খাত। এখানে প্রকৃতি নিজগুণে উৎপাদন কার্যক্রম চালু রেখেছে।
এতগুলো উদাহরণ দেয়ার অর্থ হলো, কীভাবে পৃথিবী বদলে যাচ্ছে তার কিছু কার্যকর নমুনা আপনাদের দেখালাম। এবার আমার প্রশ্ন, করোনা-পরবর্তী সময়ে কি আমরা তাহলে আর অনলাইনে এগুলো করব না? আমার ধারণা, তার সবকিছু আর ফেরত পাওয়া সম্ভব হবে না। করোনা আমাদের বদলে দেবে। বহু অফিস বন্ধ হবে। অফিসের ভাড়া ও সঙ্গে অন্যান্য খরচ কমে গেলে কোম্পানিগুলোর পক্ষে দক্ষ শ্রমিককে আরো বেশি বেতন দেয়া সম্ভব হতে পারে কিংবা কোম্পানির প্রতিযোগিতার সূচক বেড়ে যাবে। কম খরচে উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে।
আমাদের যাদের ধারণা, করোনা-পরবর্তী সময় আমরা আবার আগের মতনই হয়ে যাব, তা কিন্তু হবে না। তাই আমাদের প্রয়োজন আমাদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা। ২০০৮ সালের মন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রের বহু দোকানে কিংবা বহু বিমানে অনলাইন চেকইন চালু করেছিল। পরবর্তী সময়ে তার কলেবর কেবল বেড়েছে। সব চাকরি ফেরত আসেনি। তাই সরকারগুলো যদি মনে করে, আগামীতে আবার সব চাকরি যথাস্থানে ফেরত যাবে তাও হবে না। আমার মতে, আগামীতে পৃথিবীর সর্বত্র চাকরি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসাজগতে বিরাট পরিবর্তন আসবে। কম্পিউটারজগতে ব্লক চেইনের সংযোজন আমাদের ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনে সহায়তা করবে। ডিজিটাল অর্থনীতিকে পরবর্তী ধাপে নেয়ার জন্য এটি একটি নতুন সুযোগ।
কথায় বলে প্রতিটি বিপদ একটি নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে। হতাশ না হয়ে আমাদের পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য তৈরি হতে হবে। ২০ বছর ধরে আমি বলে এসেছি সরকারের ভাতা ব্যবস্থা কেবল সরকারি কর্মচারীদের জন্য হলে চলবে না। সরকারি কর্মচারীরা এখন আর ঔপনিবেশিক শাসকের হাতিয়ার নন যে, তাদেরই কেবল কৃতজ্ঞতার অংশ হিসেবে ভাতার আওতায় আনতে হবে। সব নাগরিককে পেনশন ভাতায় আনা প্রয়োজন, সঙ্গে বেকার ভাতার প্রচলনও সম্ভব। আমাদের অর্থনীতির প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি মানুষের জীবনযাত্রার কেন্দ্রবিন্দু এখন আর কৃষি নয়। এখানে প্রকৃতি আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখে না। চাই মানুষের হাত। তাই মানুষের হাত যখন চলবে না, তখন বিপদ অনেক। এ-জাতীয় সংকট সরকারকে বিপদে ফেলবে। সব কর্মজীবীর জন্য তাই বেকার ভাতা ও পেনশন ভাতা আমাদের এখনই চালু করা উচিত।
ড. এ. কে. এনামুল হক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট