মঙ্গলবার | মে ১৯, ২০২০ | ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭

সম্পাদকীয়

বিশ্লেষণ

করোনা ও ডিজিটাল অর্থনীতি ২০২০

ড. এ. কে. এনামুল হক

করোনার তাণ্ডব যে সহজে শেষ হবে না, তা হয়তো অনেকেই এতদিনে বুঝেছেন। আমার মার্চ মাসের লেখায় আমি বলেছিলাম যে করোনা-পরবর্তীতে পৃথিবী বদলে যাবে। এতদিনে অনেকেই তা বলছেন। অতঃপর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বলেছিলাম যে মানুষকে বেশি দিন গৃহবন্দি করা যাবে না। অর্থনীতির চাকা বন্ধ রেখে বেশি দিন দেশ চলবে না। প্রধানমন্ত্রী অতি তাড়াতাড়ি বিষয়টি নিয়ে তার মতামত দিয়েছিলেন বলেই শেষ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে আমাদের অর্থনীতি খুলে দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে। তবে আমাদের সমাজের প্রধান সমস্যা হলো, রাজা যত বলে, পারিষদ বলে শতগুণ। অর্থাৎ সরকারপ্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই ঢালাও তালে খুলে দেয়া হয়তোবা সরকারপ্রধান নিজেও আশা করেননি। হয়তোবা আবারো আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের অপেক্ষায় আছি।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে দীর্ঘদিন অর্থনীতির সব চাকা বন্ধ রাখা সম্ভব হবে না। ঢাকাসহ দেশের সব শহরেই রয়েছে হতদরিদ্র জনগণ। যাদের জীবন ঘরে বসে থাকলে চলবে না। সেদিন টিভির পর্দায় এক সাংবাদিককে দেখলাম জনগণকে দূরত্ব না মানার জন্য হেনস্থা করছেন অথচ তিনি নিজে দূরত্ব বজায় না রেখেই কথা বলছিলেন একজনের সঙ্গে! তার মতনই আমরা অনেকে নিত্যদিন টিভির পর্দায় বসে সোস্যাল ডিসট্যান্স, কনট্যাক্ট ট্রেসিং-জাতীয় শব্দ দিয়ে কী বোঝাচ্ছি, তা বোঝা ভার। আমাদের মুখে নেই দেশীয় ভাষাবাংলা-ইংরেজি মেশানো অনর্গল বাংরেজি ভাষায় বলা তাদের বক্তব্য সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে কিনা, তাতে আমার সন্দেহ রয়েছে। আমাদের অনেকেরই দেশের কঠিন বাস্তবতা নিয়ে কোনো ধারণা নেই, যা প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে। জনগণের পক্ষে রাজনীতিবিদরা কাজ করেন বলেই তা সম্ভব। বিস্তারিত বিষয়ে যাওয়ার আগে বলে রাখি করোনায় পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর হার দশমিক শতাংশ। আমাদের দেশে হারটি বেশি মনে হচ্ছে, তার কারণ আমাদের এখনো করোনা পরীক্ষার সংখ্যা কম। তবে জ্ঞাতার্থে বলি, খোদ নিউইয়র্ক প্রদেশে দৈনিক করোনা পরীক্ষার সংখ্যা - হাজারের মধ্যে।

প্রথমত, জীবন-জীবিকার তাগিদে অর্থনীতির চাকা খুলে দিতেই হবে। তবে তা করতে হবে সাবধানে এবং চলাচলের সব পর্যায়ে শারীরিক দূরত্ব (শব্দটি সামাজিক দূরত্ব নয়) বজায় রেখে। কাজটি জটিল, তবে অসম্ভব নয়। কারো কারো ধারণা, আমাদের দেশে তা করা সম্ভব না। কারণ জনগণকে তা বোঝানো যাবে না। কথাটার সঙ্গে আমি একমত নই। দেশে মসজিদগুলো নামাজের জন্য খুলে দেয়ার পর দেখা গেল তারা সুশৃঙ্খলভাবে তা পালন করতে পেরেছে। আমরা জানি যে এদের অধিকাংশই আমাদের মতো শিক্ষিত নয়, তবে তারা স্বশিক্ষিত। আমরা যারা তথাকথিত শিক্ষিত বলতে ভালোবাসি, তাদের কেন যেন একটি ধারণা আছে যে গরিব মানুষ মানুষ নয়। তাদের বুদ্ধিসুদ্ধি কম। তাদের মুখে বলে কিছু করা যায় না। অন্তত মসজিদে নামাজ আদায় করে দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা অনেক বেশি সচেতন। তাদের নিয়মে আনা সম্ভব। আমাদের প্রয়োজন সুচিন্তিত রোডম্যাপ তৈরি করা।  

দ্বিতীয়ত, কোনো কোনো গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করছে যে মানুষ যত্রতত্র ঘোরাফেরা করছে। কারণে অকারণে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে। তাদের শাস্তি দিয়ে হলেও ঘরে বন্দি করা উচিত। বিষয়টি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। যাদের ঘর বলতে সন্তান-সন্ততিসহ বসবাসের জন্য রয়েছে আট ফুট লম্বা আর পাঁচ ফুট চওড়ার একটি মাত্র কক্ষ, তাদের ঘরে বন্দি রাখার প্রচেষ্টা বেদনাদায়ক। তারা -১০ পরিবার মিলে এক স্থানে রান্না করে। গোসল করে ২০-৪০ পরিবারের সঙ্গে। আমরা তাদের বলছিঘরে থাকুন! বিচ্ছিন্ন থাকুন! পৃথক বাস করুন! সারা দিন ঘরে বসে থাকুন! যে ঘরের উচ্চতা ছয় ফুট বা তার কম। যেখানে চাল বলতে পলিথিনের চাদর। যে ঘরের নেই জানালা! দরজাও না থাকার সমান! শুধু তারা কেন, ঢাকা শহরে হাজার মধ্যিবত্ত পরিবারের ঘরে দিনের আলো প্রবেশ করে না। আলো-বাতাস নেই। কোথাও কোথাও বাতিও থাকে না। তারাও কি পারবে ২৪ ঘণ্টা ঘরে বসে থাকতে? তারা তো প্রায় দেড় মাস ধরে ঘরে বসেই আছে। আর কি সম্ভব?

আমাদের এখনই পরিকল্পনা করে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে আহাম্মকও যদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে, তবে তারা পরিকল্পনাহীন বুদ্ধিমানকে হারাতে পারে। তাই পরিকল্পনা ছাড়া বুদ্ধিদান অর্থহীন।

কী করে নিয়ম মেনে অর্থনীতির চাকা চালু করা যায়? বিষয়টি নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। নচেৎ বিপদ বাড়বে। করোনার মৃত্যুছায়া আমাদের চারপাশে ওঁৎ পেতে আছে। বিষয়বস্তুতে যাওয়ার আগে কয়েকটি বিষয় খোলাসা করা উচিত। আগেও আমি বলেছি এবং এখন অনেকেই বলছেন যে ২০২২ সালের আগে করোনার কোনো টিকা বাজারে আসছে না (যদি আদৌ আসে) যারা কয়েকটি কোম্পানির টিকার পরীক্ষা দেখে ভাবছেন যে টিকা এল বলে, তাদের অনেকেই জানেন না যে বর্তমান পরীক্ষাগুলো কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য করা হচ্ছে না। কার্যকারিতা পরীক্ষা আরো পরে হবে। এখনকার পরীক্ষা হচ্ছে এটি থেকে মানবদেহে কোনো বিষক্রিয়া তৈরি করে কিনা তা দেখতে। আপনি টিকা দিয়ে হয়তোবা কোনো করোনা থেকে বাঁচবেন, কিন্তু দেখা গেল আপনার একটি চোখ অন্ধ হয়ে গেল। তাই টিকার এই পরীক্ষা একটু সময় নিয়েই করা হয়। এরপর আসবে টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা। অতঃপর উৎপাদন বাজারজাত। আবার আবিষ্কার হলেই তা আমরা না- পেতে পারি। টিকার সর্বজনীন ব্যবহার নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলোচনায় মার্কিনিরা যোগ দেয়নি। শুধু তাই নয়, যিনিই আবিষ্কার করবেন, তাকে সম্ভবত যেতে হবে কোর্টে। কারণ তার আবিষ্কার অন্য কারো জ্ঞান চুরি করে হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করতেও অনেক দেশ প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অতএব, আগামী এক বা দুই বছর সময়ে কী করে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখা যায়, সেটাই হবে আমাদের প্রধান চিন্তা। আমাদের ভাবতে হবে নতুন সামাজিক নিয়মকানুন আমরা কীভাবে তৈরি করব। আরো ভাবতে হবে কী করে ঘনবসতিপূর্ণ দেশে তা করা সম্ভব হবে। যে দেশে দোকানের ভেতর গাদাগাদি করে জিনিস থাকে। যেখানে দোকানের জিনিসপত্রের চাপে আপনি হেঁটে ভেতরে দেখতে পারেন না, সেখানে দূরত্ব বজায়ের পশ্চিমা নিয়ম চালু করা সম্ভব কীভাবে হবে। বিদেশী টেলিভিশন দেখে আমাদের দেশেও রাস্তায় গোলাকার চিহ্ন দিয়ে জনগণকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড় করানো এই রোদ-বৃষ্টিতে অসম্ভব হবে। আমাদের ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। আমাদের প্রধান সমস্যা জনঘনত্ব। অনেকে বলেন, ঢাকা শহরে দশমিক কোটি লোক প্রতিদিন কাজ বসবাস করে। ঢাকার খালি জায়গা বাদ দিলে এই দশমিক কোটি লোক সর্বোচ্চ ১৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় অবস্থান করে। অর্থাৎ প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রতিদিন অবস্থান করে লাখ ২০ হাজার মানুষ। এত মানুষ যেন প্রতিদিন ঘর থেকে বের না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হলে আমাদের ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে।

আমাদের বর্তমান ভাবনা হবে খুচরা বাজারের পরিবর্তে শিল্প-কারখানার উৎপাদনকে কী করে তাড়াতাড়ি চালু করা যায় তা নিয়ে। কৃষি খাত চলবে। এখানে দূরত্ব বজায় রাখা নিয়ে ভীত হওয়ার প্রয়োজন কম। দেশের প্রধান শিল্প হলো আমাদের পোশাক শিল্প। তারা আমাদের আমদানি-রফতানি ডলার আয়ের প্রধান উৎস। শ্রমবাজারে যে ধস আসছে, তাতে উত্তরণের প্রধান উপায় হবে পোশাক খাতকে রক্ষা করা। বিশ্বের বাজারগুলো ক্রমে খুলছে, তাই তারা চাইবে শীতবস্ত্রের জোগান। নতুন অর্ডার দিতে চাইবে। আগামী অক্টোবরেই তা তাদের বাজারে পৌঁছাতে হলে আমাদের গার্মেন্ট জুনেই খুলতে হবে। তাতেই তারা অর্ডার পাবে। সেই অর্ডার আমরা নিতে না পারলে তা চলে যাবে অন্য দেশে। একই সঙ্গে পোশাক শিল্পে করোনার প্রভাবে হাজার হাজার শ্রমিক আক্রান্ত হলে সেসব অর্ডার কেবল স্বাস্থ্যগত কারণেই আমাদের দেশ থেকে অন্যত্র চলে যাবে। অতএব, কেবল খোলার জন্য খুললে হবে না। পোশাক কারখানায় ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখার কার্যকর ব্যবস্থা নিতেই হবে। নজরদারির দায়িত্ব হবে সংশ্লিষ্ট মালিক সমিতির। সরকারি সংস্থাও থাকবে নজরদারিতে এবং তাদের সহায়তা করতে। সেক্ষেত্রে শ্রমিকের সংখ্যা কমাতে হবে। বিষয়টি সবাইকে বুঝতে হবে। শ্রমিকদের আবাসস্থল স্বাস্থ্যকর নয়। তাদের আবাসস্থলে সমিতির সহায়তায় স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন পানি, সাবান প্রয়োজনে ডাক্তার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের দায়িত্ব হবে শ্রমিকের স্বাস্থ্যগত সুব্যবস্থার স্বার্থে সমিতিগুলোকে সহায়তা করা। একই ব্যবস্থা চালু করতে হবে প্রতিটি শিল্প এলাকায়। শিল্প এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কারণ তা না হলে শ্রমিকের অসুস্থতা শিল্প খাত তথা অর্থনীতিকে বিপদে ফেলবে। শিল্প এলাকা যেন লকডাউনে না পড়ে, তার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।

শিল্প ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত পোর্ট, কাস্টমস, ব্যাংক, বীমা যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাদের আবদ্ধ রেখে শিল্প খাত বেশিদিন চলবে না। তাই যাতায়াত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। এখানেও প্রয়োজন হবে ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম পালনের। এদের অনেকেই ঘরে বসে কাজ চালু রাখতে পারবে। যেমন টিকেটিং করা যাবে অনলাইনে বা ফোনে। ব্যাংক-বীমাও চলবে ফোনে বা অনলাইনে। এই কয়টিকে যথাসম্ভব ঘরে রেখে অন্য সেবা খাতগুলো চালু করা উচিত।

প্রয়োজন হবে নগরে যাতায়াত ব্যবস্থা চালু করা। ঈদের পর পরই এসব খাত চালুর পদক্ষেপ নিতে হবে। আন্তঃনগর বাস চলাচল সীমিত রাখতে হবে। আর তাদের অন্তত কিছু বাস শহাঞ্চলে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। তাতে নগরের অভ্যন্তরে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হবে। আর তার সঙ্গে ভিড়ও কমবে। আবার প্রতিটি বাসের অভ্যন্তরে দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম চালু করতে হলে প্রয়োজন পড়বে বাসের যাত্রী সংখ্যা সিটের অর্ধেকে নামিয়ে আনা। অতিরিক্ত যাত্রীর জন্য পথে মাঝে মাঝে নিরীক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। তার ব্যত্যয় ধরা পড়লে থাকবে শাস্তি। যাত্রীদের ভাড়া গ্রহণ করা হবে বিকাশ বা সমজাতীয় কোনো -মাধ্যমে। খুচরা টাকা-পয়সার লেনদেন করোনার সব অর্জন ব্যর্থ করবে। হাত ধোয়ার সব কার্যকারিতা ম্লান করে দেবে। লেনদেনে টাকার প্রচলন কমিয়ে দেয়া উচিত।

প্রয়োজন হবে সব পণ্যের পাইকারি বাজার ব্যবস্থা চালু করা। তবে সেখানেও থাকবে দূরত্বের নিয়ম। চালু হবে নির্মাণ শিল্প, চালু হবে নগরের রেস্টুরেন্ট। তবে হোটেলের ভেতর বসার ব্যবস্থায় চালু থাকবে একই নিয়ম। চালু হবে পাঠাও মোটরযান, তবে তা যাত্রী পরিবহনে নয়; বরং তা হবে বাড়ি বাড়ি খাবার বা খুচরা বাজার পৌঁছে দেয়ার জন্য। ডেলিভারি যান হিসেবে। মোটরসাইকেলে এক পরিবারের লোক ছাড়া দুজন একসঙ্গে চলবে না। পাশাপাশি বসার ক্ষেত্রে একই ব্যবস্থা থাকবে উবার, সিএনজি, টেম্পো কিংবা বাসের যাত্রীদের ক্ষেত্রেও। নগর জীবনের সব সুবিধা চালু রেখে কী করে জনসমাগম কমানো যায়, তাই হবে আমাদের প্রচেষ্টা। সম্ভব হলে চালু করা উচিত মোবাইলভিত্তিক ভ্রমণ-অনুসরণ (Contact Tracing) করার অ্যাপ। সেই সঙ্গে দেশব্যাপী লকডাউন না করে, যদি দেখা যায় যে কোনো এলাকায় করোনার ব্যাপক প্রাদুর্ভাব হয়েছে, তখন সঙ্গে সঙ্গেই কঠোরভাবে স্থানীয় লোকালয় বা শহরকে লকডাউনের আওতায় আনা। অন্তত আগামী বছর দুয়েক আমাদের এভাবেই চলতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

খুচরা বাজারকে যেতে হবে যথাসম্ভব অনলাইনে কিংবা বলা চলে ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে। যেমন করে আমি বসুন্ধরায় যাই, তেমনি হবে আমাদের অনলাইন পোর্টাল। তাতে আমি দোকানে অনলাইনে দোকানির সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনে দাম-দর করে জিনিসপত্র কিনতে পারব। ব্যবস্থা চালু করবে সংশ্লিষ্ট দোকান সমিতি। তাতে নিউমার্কেটের জন্য হবে একটি পোর্টাল, গাউছিয়ার জন্য আরেকটি পোর্টাল রকম। অফিসগুলোয় চালু হবে এলাকাভিত্তিক শুরুর সময়। তাতেও দেখা যাবে যানবাহনে চাপ কমবে। আর যারা দোকানের ভেতর ক্রেতা আনবেন, তাদের জন্য নিয়ম হবে প্রতি নয় বর্গফুট এলাকায় তারা একজন ক্রেতা ঢোকাতে পারবেন। দোকানের আয়তন অনুযায়ী তারা নির্ধারণ করবেন সর্বোচ্চ কতজন ক্রেতা একসঙ্গে তার দোকানে ঢুকবেন, যা স্পষ্টাক্ষরে দোকানে প্রদর্শিত থাকবে। তাতে শাস্তি প্রদান সহজ হবে।

সরকারি সব অফিসে থাকবে অনলাইন বা ফোনে সেবার ব্যবস্থা। প্রতিটি সেবার জন্য চালু হবে -কাউন্টার। আমি -কাউন্টার বলতে কেবল শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য বলছি না, থাকবে কল রেকর্ডিং ব্যবস্থা। ফলে আমি মুখেও বলে দিতে পারব কী চাই। -কাউন্টারের পেছনে থাকবে একটি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যেন সেবা কাউন্টারে সেবাটির সর্বশেষ অবস্থা আমি ফোনের মাধ্যমেই জেনে নিতে পারি। সব লেনদেন হবে বিকাশ বা সমজাতীয় ব্যবস্থায়। ক্যাশ থাকবেই না। প্রয়োজনে ব্লকচেইনের ভিত্তিতে -মানি চালু করার কথা চিন্তা করা উচিত, যা চীন এরই মধ্যে চালু করেছে। তাতে দুর্নীতি কমবে। প্রতিটি সরকারি সেবা সংস্থায় চালু থাকবে ইলেকট্রনিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। তাতে একদিকে কার কাছে কোন কাজ কতদিন পড়ে আছে, তার ওপর নজর রাখা যাবে, তেমনি কে দিনে কতগুলো কাজ করেছে, তাও জানা যাবে। প্রধানমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন সবাই বুঝতে পারবেন কে কাজ করছেন আর কে করছেন ফটোসেশন। এসব প্রস্তুতির জন্য আইসিটি মন্ত্রণালয় তৈরি করবে প্রমিত রীতি নীতি। এখনই দায়িত্ব দিতে হবে। ব্লকচেইন কৌশল ব্যবহার করে কাজ করলে নজরদারি করাও হবে অতিসহজ। আর এতে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় একা কেউ কোনো রেকর্ড পরিবর্তন করতে পারবে না। নজরদারির সব ব্যবস্থা হবে ব্লক চেইনভিত্তিক। তাতে কোনো সংস্থা সহজে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারবে না।

হাসপাতালগুলোয় চালু হবে নতুন নিয়ম। নাম হাসপাতাল হলে তাকে প্রথমে জরুরি সেবা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। অতঃপর করবে রোগীকে অন্য কোনো হাসপাতালে স্থানান্তরের চিন্তা। নচেৎ তাদের নাম পরিবর্তন করে ক্লিনিক করুন। তাতে জনগণ বুঝতে পারবে কোনটি হাসপাতাল আর কোনটি নামসর্বস্ব হাসপাতাল। জরুরি বিভাগে অবশ্যই থাকতে হবে সার্বক্ষণিক ডাক্তার। কয়েক বছর আগে আমি গিয়েছিলাম গৌহাটিতে (বর্তমান নাম গুয়াহাটি) একটি বেসরকারি হাসপাতালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। আসামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করলেন। উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বললেন, বেসরকারি হাসপাতালে কোনো সরকারি ডাক্তার আসতে পারবেন না। তাদেরকে সেবা দিতে হবে সরকারি হাসপাতালেই। বেসরকারি হাসপাতালে যদি কোনো সরকারি ডাক্তার সেবা দিতে আগ্রহী হন, তবে তাকে সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে আসতে হবে। তার বলিষ্ঠ বক্তব্য কেঁপে ওঠার মতন। তার মতে, ডাক্তাররা গাছের ফল উপরেরটা খাবেন আবার তলানিরটাও খাবেন, তা হবে না। এজন্য সরকার তাদের চাকরি দেয়নি। ঘটনাটি বললাম এজন্য, সময় এসেছে আমাদেরও বলিষ্ঠ পদক্ষেপের। নচেৎ গরিব অসহায় জনগণ চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় করোনায় মারা যাবে। আর বেসরকারি হাসপাতালকে ডাক্তার বা নার্স পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে আনার পথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। সবই হবে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য। তাতে বিদেশে গিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা চিকিৎসার জন্য আমাদের জনগণকে খরচ করতে হবে না। চিকিৎসা ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করার ক্ষেত্রে আমাদের এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।

সেপ্টেম্বরের আগে স্কুল-কলেজ চালু করার চিন্তা না করাই ভালো। তবে এর মধ্যে কয়েকটি বিষয় সমন্বয় করতে হবে। প্রাইমারি পর্যন্ত সব স্কুলকে (কেজি স্কুলসহ) তাদের ছাত্র সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে এবং দুই কিলোমিটারের মধ্য থেকে তাদের ছাত্র নিতে হবে। তার বাইরের ছাত্রদের তারা যদি সেবা দিতে চায়, তবে স্কুলের শাখা চালু করতে পারবে সেসব স্থানে, যেখানে ছাত্ররা থাকে। অর্থাৎ প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুল ডিস্ট্রিক চালু করা উচিত। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে প্রতিটি স্কুলকে তা নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্যই রাখতে হবে হাত ধোয়া দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা। উচ্চতর বিদ্যালয় কলেজের ক্ষেত্রে একই নিয়ম থাকবে, তবে দুই কিলোমিটারের বদলে তা হবে চার কিলোমিটার। তাতে যাতায়াত ব্যবস্থার ওপর চাপ কমবে। শহরে সাইকেল লেন চালু করতে হবে। তাতে সাইকেলে লোক চলাচল বাড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ক্লাসে ছাত্র সংখ্যা অর্ধেকে নামাতে হবে। তবে তাদের ক্ষেত্রে অনলাইনে ক্লাস চালু রেখে কী করে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যায়, সেই চিন্তা করতে হবে। এসব কার্যক্রমে যাতায়াত ব্যবস্থার ওপর চাপ কমে যাবে। বিচার কার্যক্রমের জন্য এরই মধ্যে চালু হয়েছে ভার্চুয়াল কোর্ট, যা আগামীতে অব্যাহত থাকবে।

নগরসেবার সব কার্যক্রম স্বাভাবিকে আনতে হবে, তবে দূরত্ব বজায় রেখে। জনঘনত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি নগরে অন্তত প্রতি কিলোমিটার একটি করে হাত ধোয়াসহ শৌচাগার চালু করতে হবে, যেখানে সেবা পাওয়া যাবে নির্দিষ্ট ফি-তে। ফি দিতে হবে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে। নগদে নয়। আমাদের ডিজিটাল অর্থনীতির দ্বিতীয় পর্যায় চালুর এখনই সময়। আশা করি সবাই ভাববেন। যেহেতু টিকা আবিষ্কারের ইতিহাস বলে যে কোনো আবিষ্কৃত টিকা আবিষ্কারের অন্তত ১৮ মাসের আগে বাজারে আসে না, তাই আগামী দু-তিন বছর আমাদের চলতে হলে এর কোনো বিকল্প রয়েছে বলে আমি মনে করি না।

 

. . কে. এনামুল হক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন