বুধবার | জুন ১৭, ২০২০ | ২ আষাঢ় ১৪২৭

সম্পাদকীয়

বাজেট ২০২০-২১

কালো টাকার গল্প

ড. এ. কে. এনামুল হক

লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট। আগামী এক বছরে সরকারি খরচের পরিমাণ এটি। ঘাটতি বাজেট। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ৪৫ বছর ধরে আমরা ঘাটতি বাজেটই দিয়ে এসেছি। তাই অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। কোথায় খরচ হবে? খরচের বেশির ভাগই হয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাবদ। বাজেটে নতুন কিছু নেই। তবে আশাও করিনি। করোনার জাঁতাকলে যখন অর্থনীতি স্থবির তখন ঘাটতি যে হবেই, তা সবাই জানে। জনগণ যেখানে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে, তখন সরকার আর কী করবে? করের বোঝা বাড়াবে? সম্ভব নয়। খরচ কমাবে? তাও সম্ভব নয়। টাকা কোথা থেকে আসবে, তা নিয়ে অনেকেই ভণিতা করে প্রশ্ন করেছেন। আমি কারণ বুঝিনি। আয় নেই কিন্তু ব্যয় আছে, তাই টাকা কোত্থেকে আসবে? এর সহজ উত্তরঋণ। বিদেশী সাহায্য? সবাই এখন রয়েছে বিপদে। গতকালের খবর, ব্রিটেন সরকার করোনার প্রাক্কালে আহ্বান জানিয়েছিল বিভিন্ন হোস্টেল, বিশ্ববিদ্যালয় যেখানেই থাকার জায়গা রয়েছে, সেখানেই গৃহহীনদের আশ্রয় দিতে। বলেছিল যে মহামারীর সময় তারা আশ্রয় দিলে সরকার তাদেরপ্রণোদনাবা ভাড়া দেবে। সরকার ভাবেনি এতদিন তাদের রাখতে হবে। সবাই আমাদের মতোই ভেবেছিল যে দু-তিন সপ্তাহ বড়জোর এক মাস, তার পরই আসছে সুদিন। এখন খোদ ব্রিটিশ সরকারই কুপোকাত। এত ভাড়া দেয়ার সাধ্য নেই তাদের। আমাদের অবস্থাও এমনই। সাধারণ ছুটি কাজে লাগেনি, লকডাউন, কঠিন লকডাউন কাজে আসবে? মোটেও না। চীনে আবারো করোনা ফেরত এসেছে। করোনার আসা-যাওয়া চলবে। বিপদ সহজে পিছু ছাড়ছে না। বহুলোক প্রাণ হারিয়েছে। যাদের নামডাক রয়েছে, তাদের জন্য অন্তত টিভিতে ?ন্না লিল্লাহি... পড়া হয়। যাদের তা নেই, তারা যাচ্ছেন নীরবে। অবস্থায় অর্থমন্ত্রী যে বাজেট নিয়ে সংসদে এসেছেন, সেজন্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। আমার তো ধারণা ছিল এবারের বাজেট দেবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী!

সমালোচনা এসেছে বেশ। তবে অবাক করার মতন নয়। কারণ সমালোচকদের ভাষাও কিন্তু গতানুগতিক। তাই আলোচনা বা সমালোচনা করতে নয়, তবে বাজেটের কিছু ব্যাখ্যা তুলে ধরতেই লিখছি। বাজেটের ঘাটতি নিয়ে আলোচনার খুব বেশি নেই। আগামী বছরে সরকারের আয় বাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না এখন পর্যন্ত। তা সত্ত্বেও অর্থমন্ত্রী ভেবেছেন আগামী বছরে সরকার বছরের চেয়ে আরো প্রায় শতাংশ বেশি কর পাবে! হিসাব মতে, আগামী বছরে সরকারের আয়কর থেকে আয় বাড়বে, ভ্যাট থেকে আয় বাড়বে, সম্পত্তি কর থেকে আয় বাড়বে ইত্যাদি! খরচের খাতার দিকে তাকালে দেখা যায়, বেতন বাবদ খরচ বাড়বে, অফিস-আদালতে খরচ বাড়বে, যাতায়াত খরচ বাড়বে, প্রশিক্ষণ বাবদ খরচ বাড়বে, সুদের খরচ বাড়বে, উন্নয়ন ব্যয় বাড়বে ইত্যাদি। অতএব দেখা যায়, আমাদের অর্থনীতিতে তেমন কোনো বিরাট পরিবর্তন হবে না। যেভাবে চলছিল সেভাবেই চলবে। তবে এটুকু বোঝা যায় যে সরকারের ঋণ বাড়াতেই হবে। কোত্থেকে ঋণ নেবে? তা নিয়ে বেশি প্রশ্ন না করাই ভালো। তবে কোথাও কিছু না পাওয়া গেলে সরকার টাকা ছাপিয়ে হলেও খরচ করতে পারে। এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। অ্যাকাউন্টিংয়ের খাতায় অবশ্য তাও এক প্রকার ঋণ। বড় বড় প্রকল্প শেষ করতেই হবে নচেত খরচ আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। তাই যারা বলছেন যে, মুহূর্তে বড় বড় প্রকল্পের খরচ কমিয়ে আনা প্রয়োজন, তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ তখন ওইসব প্রকল্পের ব্যয় এক বছর দেরি করলে বেড়ে আরো ১০ গুণ হয়ে যাবে। ঋণের বোঝা তাতে আরো বাড়বে। কর বাড়ানোর সম্ভাবনা খুব বেশি নেই। এই অসময়ে আমাদের বাড়তি খরচ হলো মোবাইলের ইন্টারনেট, সেখানেও নতুন কর এসেছে। তবে এখানে না বাড়ালেই হতো। সবাই যেখানে মোবাইলের ব্যবহার বাড়িয়েছে, তখন খাতে এমনিতেই কর আয় বাড়বে। নতুন কর না দিলেও বাড়বে। তাই অযথা এই কর সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। ১৬ কোটি মোবাইল গ্রাহক এখন। তার মানে দেশের সবাই কর দিচ্ছে। অন্য কথায় বলতে গেলে, এখানে কর বাড়ানো মানেই ১৬ কোটি লোকের পকেটে হাত দেয়া। সরকারের পক্ষে জনমত থাকবে না। এমনিতেই যেখানে বাড়তি ব্যবহারের জন্য সরকারের আয় বাড়বে, সেখানে নতুনভাবে কর বাড়িয়ে অর্থমন্ত্রী ১৬ কোটি লোকের বিরাগভাজন হবেন। ঘরে বসে সবাই মোবাইলে সব কাজ করছে। পড়ালেখা করছে। অফিস করছে। বাজার করছে। এখন সরকার সবার কাজেই করের বোঝা বাড়াল। দরকার ছিল না। অধিক ব্যবহারের ফলে খাতের কর আয় এমনিতেই বাড়বে, তাই আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রধানমন্ত্রী তা কমিয়ে আনবেন।

বলছিলাম ঘাটতি বাজেট নিয়ে অধিক চিন্তা না করে কী করে আয় বাড়ানো যায়, সেই চিন্তাই করা উচিত। অর্থমন্ত্রী তাই একটি কাজ করেছেন। বলেছেন কালো টাকাসাদাকরার কথা। অনেকেই কালো টাকাকে কালো বলে মনে করেন। বাজেট বক্তৃতায় আছে করবহির্ভূত আয় যেখানেই থাকুক না কেন, তার ১০ শতাংশ কর দিয়ে দিলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। আর শর্তসাপেক্ষে যদি করবহির্ভূত সম্পদ স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করা হয় তাহলেও প্রশ্ন করা হবে না। অনেকেই সংগত কারণেই তার সমালোচনা করছেন। এর পেছনে নৈতিক স্খলন রয়েছে কিনা, সে বিতর্কে না গিয়ে আমি বিষয়টিকে সাধারণের কাছে পরিষ্কার করতে চাই।

প্রথমত, কালো টাকা বা করবহির্ভূত আয় কীভাবে তৈরি হয়? অনেকেই জানেন, আপনি যখন আয়কর দিতে গিয়ে কোনো আয় জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অন্তর্ভুক্ত করেন না, তখনই তা করবহির্ভূত আয় হয়। আপনার আয় কালো নয়। পরিশ্রম করে আয় করেছেন। আপনি নিয়মানুসারেই আয় করেছিলেন, কিন্তু সেই আয়ের ওপর আয়কর দেননি। নিয়মমতো এটি করবহির্ভূত আয়। অনেকে বলেন কালো টাকা। বিশেষণের জ্বালা অনেক। পরিশ্রমের আয় অথচ মনে হচ্ছে অপরাধীর আয়। আয় অবৈধ নয়। আপনার অপরাধ আপনি কর ফাঁকি দিয়েছেন। বিশেষণটি এমনভাবে ব্যবহূত হয়েছে যে মনে হবে অবৈধ আয়। যারা কর দেন না, তাদের আয় কি অবৈধ? আয় কিন্তু কালো নয়।

দ্বিতীয়ত, কার কাছে থাকে এই তথাকথিত কালো টাকা। এই দেশে ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর চার কোটি পরিবার। গত অর্থবছরে মাত্র ২০-২২ লাখ লোক আয়কর দিয়েছেন (অর্থমন্ত্রী সঠিক সংখ্যা দিতে পারেননি তার বক্তৃতায়) কারো বার্ষিক আয় লাখ ৫০ হাজার টাকার (অর্থাৎ মাসে ২০ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে) বেশি হলেই তাকে আয়কর দাখিল করার নিয়ম। তাই যারা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেননি, তাদের সবার পকেটেই রয়েছে কালো টাকা। আর করদাতাদের মধ্যে যারা আয় লুকিয়েছিলেন কিংবা উল্লেখ করেননি, তাদের পকেটেও কালো টাকা রয়েছে। সেই অর্থে দেশে আয়কর দেয়ার উপযুক্ত প্রায় এক কোটি পরিবারের পকেটে কালো টাকা রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের পকেটেই কালো টাকা আছে। বলবেন না, এরা সকলেই অবৈধ সম্পদের অধিকারী! এরা নানা কারণে সরকারকে কর প্রদানে রাজি হননি।

তৃতীয়ত, কালো টাকা দিয়ে কী করা যায়? সাধারণ অর্থে সবই করতে পারেন। কিন্তু যখনই কোনো সম্পদ তৈরি করতে যাবেন তখনই আপনাকে কর বিভাগ ধরে ফেলতে পারে। ধরুন আপনি গাড়ি কিনবেন, জমি কিনবেন, বাড়ি কিনবেন, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করবেন, বিদেশে ঘন ঘন ভ্রমণ করবেন, সব ক্ষেত্রেই আপনাকে কর বিভাগ ধরে ফেলতে পারে। সেজন্য প্রয়োজনীয় আইনও রয়েছে। তবে একসঙ্গে এক কোটি লোককে ধরতে গেলে সরকারেরই বিপদ বাড়বে। তাই একসঙ্গে এক কোটি লোককে ধরার চেষ্টা করা অবান্তর। সেজন্যই প্রতি বছর বাজেটে কালো টাকার কথা আসে।

চতুর্থত, কেন কালো টাকা ধরা যায় না? এক্ষেত্রে কর বিভাগের সততার অভাব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সরকারের নানা প্রতিবন্ধকতা। আগেই বলেছি, একসঙ্গে এক কোটি লোককে কালো টাকার জন্য ধরতে গেলে সরকারের টিকে থাকাই অসম্ভব হবে। সরকারকে জনগণের সরকার মনে হবে না। তাই সরকার তৈরি করে করদাতা ধরার নানা ফাঁদ। যে সেই ফাঁদে পা দেবে তাকেই ধরবে। কী সেই ফাঁদ? আপনি সন্তানের বিয়ের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করবেন? বিদেশে যাবেন ঘন ঘন? গাড়ি কিনবেন? জমি কিনবেন? সব ক্ষেত্রেই আপনাকে ধরার জন্য ফাঁদ পাতা রয়েছে। তাই ধরা পড়লে বিপদ হবে।

পঞ্চমত, তাহলে আমি কী করব? আপনি চাইবেন সম্পদ তৈরির আগে আয়কর দিতে। অর্থাৎ এতদিন কর না দিলেও যখনই ভাববেন সম্পদ গড়বেন, তখনই আপনার প্রথম কাজ হবে আপনার লুকানো টাকা প্রকাশ করা। আইন অনুযায়ী তা না করা গেলে কোটি পরিবার বিপদে পড়বে। ভেবে দেখুন আপনার বৈধ আয় থেকে জমানো অর্থ আপনি ব্যবহার করতে গিয়েই বিপদ হতে পারে। তাই সুযোগ থাকা প্রয়োজন কীভাবে তা থেকে আপনি কর দেবেন। তাই কালো টাকা প্রকাশের জন্য সব দেশেই রয়েছে আইন। তবে বিশেষ আইন বা ধারা নয়, সাধারণ কর আইন। আমাদের অসুবিধা হলো, আমরা বিশেষ আইনে বিশ্বাস করি। মনে করি যেন একটি বিশেষ লোকের জন্য আইন! যেমন সবাই ভাবছেন কালো টাকা সাদা করার ফলে লোকজন বিদেশে সম্পদ পাচার করবে না। অর্থাৎ বিদেশে টাকা পাচার বন্ধে আইন করা হয়, তা কিন্তু নয়। সাধারণ মানুষ যারা আয়কর দেননি কিংবা সম্পদ তৈরি করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন এবার কর দেয়া দরকার, তাদের জন্যই প্রয়োজন করবহির্ভূত আয় প্রকাশের সুযোগ রাখা। ধরুন আপনি একজন স্কুলশিক্ষক। সারা জীবন কর দেননি, কিন্তু ছাত্র পড়িয়ে অতিরিক্ত আয় ছিল কিংবা আপনি একজন শিক্ষিকা, সারা জীবন আপনার আয় সযতনে সঞ্চয় করেছেন। এখন ভাবছেন বাড়ি করবেন। ছোট একটি ঘর। আপনাকে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। দেখতে পাবেন আপনার কর দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু যে দেশে মাত্র ২০ লাখ লোক কর দেয়, সে দেশে আপনি ভাবেনইনি আপনাকে কর দিতে হবে। আপনার আয়ও করবহির্ভূত, কিন্তু অবৈধ আয় নয়।

ষষ্ঠত, কী করা যায় কালো টাকা নিয়ে? ভেবে দেখুন। আপনার আয় কর বিভাগের অগোচরেই ছিল। তারা আপনাকে তাদের ফাঁদে ধরতে পারেনি। এখন আপনি স্বেচ্ছায় কর দিতে চাইছেন। এটি আপনার মনে হতেই পারে। আপনার জন্য সেই সুযোগ থাকা কি উচিত নয়? যদি না থাকে, তবে আপনি ধরা পড়লে অপরাধী হবেন। তাই করবহির্ভূত আয় প্রকাশ করার সুযোগ সবসময়ই থাকা উচিত। সমাজে সততা ফিরিয়ে আনার জন্যই নিয়মের প্রয়োজন। প্রশ্ন হবে এবার আমার নিজের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কি আমাকে অপরাধী করা যায়? ন্যাচারাল জাস্টিস বা প্রাকৃতিক বিচারে তা হয় না। আপনার জন্য এই সুযোগ আপনার একটি নাগরিক অধিকার। তবে এজন্য কি আপনি একটি ফরম পূরণ করবেন? আমার মতে, তা করা অনুচিত। কারণ কোনো অপরাধ এখানে ঘটেনি। আমি নিজে আমার করবহির্ভূত আয় প্রকাশ করছি মাত্র। আমাকে বিশেষ ফরম ব্যবহার করতে বলবেন না। আমি যখনই আয় ঘোষণা দেব, তখনই আমাকে নিয়মমাফিক কর দিতে বলুন। তবে আমার ঘোষণার ফলে আমাকে কর বিভাগ যেন হেনস্তা করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা সাধারণ আইনেই থাকা উচিত।

বিশেষ ফরম ব্যবহার করে বা বিশেষভাবে তা প্রকাশ করে আমাকে অপরাধীর দলে নাম লেখাতে বললে অনেকেই তা করতে চাইবেন না। যদি করবহির্ভূত আয় হতে কর বাড়াতে হয়, তবে বিশেষ নিয়ম করে ঘোষণা করে কর দেয়ার নিয়ম করলে তা হবে না। অতীতে তাই কোনো কাজ হয়নি, এখনো হবে না।

আর আপনি যদি বিশেষ লোক হন, কোনো বিনিয়োগকারী, কোনো ব্যবসায়ী, কোনো রাজনীতিবিদ বা বিশাল কোনো ব্যক্তিত্ব, তবে ঘোষণাপত্রই আপনার জন্য কাল হবে। আয়কর বিভাগ হয়তোবা আইনের কারণে আপনাকে প্রশ্ন করবে না, তবে তা জনসমক্ষে ফাঁস করে দিতে পারে। আপনাকে যে কেউ অপদস্থ করতে পারবে। অতএব, বিশেষ নিয়মে কালো টাকা সাদা করার নিয়ম অযথা। এর সুযোগ বুদ্ধিমান কেউ নেবেন না। ফলে প্রতি বছর অর্থমন্ত্রী তা বলেন, কিন্তু কাজে আসে না।

তাহলে কী হবে? কী করবেন এইকালো টাকাদিয়ে? আপনি আরো অসৎ হবেন। আরো লুকাবেন। সম্ভব হলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিদেশ পাড়ি দেবেন। টাকা পাচার করবেন। হুন্ডি করবেন। দলবাজি করবেন যেন আপনাকে কেউ ধরতে সাহস না পায়। সরকারি দলে যোগ দেবেন। অথচ কোনো কিছুরই দরকার ছিল না যদি আইনটি চিন্তা করে তৈরি করা হতো। 

কালো টাকা দিয়ে অর্থনীতি চাঙ্গা করবেন? অর্থমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী স্টক মার্কেটে ঢালবেন? জলে ফেলবেন আপনার কষ্টার্জিত সম্পদ। আপনি চুরি করে এই টাকা আয় করেননি। তাই তাও আপনি করবেন না। তবে অপরাধীরা করতে পারে। দেশের কোটি লোক অপরাধী নয়।

তবে কালো টাকা লুকানোর জন্য নানা লুকানো ব্যবস্থা তৈরি হবে দেশে। অর্থনীতি ক্রমে সরকারের নাগালের বাইরেই চলে যাবে। দেশের বাড়ি দেখবেন, গাড়ি দেখবেন, লাখ টাকার মোবাইল ব্যবহারকারী পাবেন। কিন্তু করদাতা পাবেন না। তাই প্রয়োজন করবহির্ভূত আয় প্রকাশের জন্য সাধারণ আইন তৈরি করা। আবারো বলছি, বিশেষ আইন নয়। বাজেটে বিশেষ ব্যবস্থাও নয়।

সরকারের প্রয়োজন প্রচুর ঋণ। ঋণ করতে গিয়ে সরকার যাবে ব্যাংকের কাছে। ব্যাংকে কালো টাকা রাখা বিপজ্জনক। আমাদের দেশে এটাও একটি কর ধরার ফাঁদ। ধরা পড়ে যেতেও পারেন। তাই কোটি মানুষ যাদের কাছে করবহির্ভূত সম্পদ রয়েছে, তারা ব্যাংক বা এই জাতীয় প্রতিষ্ঠান এড়িয়ে চলবেন। সরকার তখন ব্যয় সামলানোর জন্য টাকা ছাপবে। বাড়বে মূল্যস্ফীতি। সরকারের অবস্থা নাজুক হবে।

কর ফাঁকিবাজদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান, তাদের জন্য রয়েছে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক। তারা তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। তাদের ধরা অসম্ভব। সাধারণ মানুষ যাদের সেই বিশেষজ্ঞ নেই, তারা পড়বে বিপদে। তারা ব্যাংক এড়িয়ে চলবে। ক্ষতি হবে অর্থনীতির। বিনিয়োগকারী দেখবে ব্যাংকে সঞ্চয় নেই। সরকারও ঋণগ্রহণের সুযোগ হারাবে। তাই ব্যাংকে টাকা রাখাকে ফাঁদ হিসেবে তৈরি করবেন না। তাতে অর্থনীতির ক্ষতি হয়। ব্যাংকে টাকা জমা থাকলে তা কখনই পাচার হয় না। দেশে  বিনিয়োগ হয়। কথাটি মনে রাখতে হবে। তাই অর্থমন্ত্রীর উচিত ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার ওপর কর বিভাগের নজরদারি কমিয়ে আনা। তাতে ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ বাড়বে। অর্থনীতি গতি পাবে।

বলতে পারেন, অপরাধজনিত লেনদেনের ওপর নজরদারি কি বাদ যাবে? না তা নয়। সন্দেহজনক অপরাধমূলক লেনদেনের ওপর নজরদারি আর আয়কর বিভাগের নজরদারি এক নয়। আয়কর বিভাগকে ব্যাংক থেকে নজরদারির অধিকার উঠিয়ে দিলেই দেখবেন দেশের টাকা দেশে থাকবে। কর ফাঁকিবাজদের ধরতে গিয়ে নাগরিক অধিকারে হাত না দিলে দেখবেন সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে। আর দেশের প্রতি নাগরিকের আস্থাই একটি দেশকে সফল করতে পারে।

তাই করবহির্ভূত আয় নিয়ে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নয়, সাধারণ আইনের নিয়মেই আয়কর নেয়া প্রয়োজন। দেখবেন যখনই আয়ের ওপর ব্যাখ্যা নিয়ে কর বিভাগের মাতামাতির অধিকার না থাকবে তখনই লোকজন আয়কর দিতে উৎসাহী হবে। তবে আয়কর বিভাগ তার নানা ফাঁদ দিয়ে করদাতাকে ধরবে, সেই অধিকার তাদের থাকবে। আমার নিজের দেয়া তথ্যের ওপর প্রশ্ন করে নয়। অন্যদিকে কর বিভাগ আমাকে ধরার আগেই যদি আমার আয়ের ঘোষণা দিয়ে সেই আয়ের ওপর কর দিতে যাই, তখন কর বিভাগের অধিকার থাকবে না আমাকে হেনস্তা করার। সব দেশের কর আইনে তা- বলে। আমাদের আইনও তা- থাকা উচিত। আমার করবহির্ভূত আয় তিন বছরের মধ্যে ধরতে না পারলে আয়কর বিভাগের প্রশ্ন করার অধিকার থাকা উচিত নয়। মানুষ আয়কর দেবে উৎসাহী হয়ে, নির্দ্বিধায়, নিশ্চিন্তে। শ্রেষ্ঠ নাগরিক হওয়ার স্বার্থে। পৃথিবীর যত দেশেই করদাতার সংখ্যা বেড়েছে, সে দেশেই ধরনের নিয়ম রয়েছে। আমি কর বেশি দিয়ে ফেললে তা সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থাও থাকা প্রয়োজন, তখন আমি কর দিতে উৎসাহী হব। ফাঁকি দিতে নয়। অনেক দেশই এসব ব্যবস্থা চালু করেছে।

সব শেষে, ধরুন আপনার কালো টাকা সত্যিই কালো। আপনি অপরাধমূলক কাজের মাধ্যমে আয় করেছেন। এবার ধরুন আপনি সরকারের নীতি অনুয়ায়ী ঘোষণা দিয়ে আয়কর দিলেন। আপনার অপরাধ কি না- হয়ে যাবে? আপনার আয় কি সাদা আয় হয়ে যাবে বা হওয়া উচিত? নিশ্চয় তা হতে পারে না।  আবার মনে করুন, আপনার কালো পথে আয়ের কালো টাকার কর দিয়ে তাসাদাকরার পর আপনি অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হলেন। আপনার কি শাস্তি হবে না? হতেই হবে। আপনি কি আপনারসাদাসম্পদ ধরে রাখতে পারবেন? না। তাহলে কেনকালো টাকা বিশেষ আইন? বিশেষ আইনের দরকার নেই। সাধারণ নিয়মে করদাতাকে কর দিতে বলুন। দেখবেন করদাতার সংখ্যা বাড়বে। অর্থমন্ত্রী একজন ব্যবসায়ী। তিনি নিশ্চয় এসব মারপ্যাঁচ বোঝেন। তাই তার কাছে আশা করেছিলাম ভিন্ন এক বাজেট। বুদ্ধিদীপ্ত বাজেট। সম্ভাবনার বাজেট। অর্থনীতিকে বিকাশের বাজেট।

 

. . কে. এনামুল হক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন