ধারণা হয়েছিল, আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভুল ভাঙল যখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তুললেন সংসদে। ‘এক মাসের খাবার বিল কী করে ২০ কোটি টাকা হয়?’ প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরে সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে যে বিষয়টি ডাহা মিথ্যা। বিলটি খাবার বিল নয়। খাওয়া ও থাকার বিল এবং তা এক মাসের বিল নয়। কাকে বিশ্বাস করব বুঝতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী তথ্য না নিয়ে কথা বলেন না। সংসদে তার বক্তব্যের সময় সামনে একটি কাগজ দেখে পড়ছিলেন বলেই সংবাদে দেখেছি। সংবাদ সম্মেলনে কলেজটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন ডাক্তার। আমার বিরক্তি সেখানে। সবাই বুঝেছি, যা কিছু ঘটেছে তার সঙ্গে ডাক্তার জড়িত নন। জড়িত ছিল বা আছে তাদের প্রশাসন। এসব বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কি এসব বিলেও প্রতিস্বাক্ষর করেছিলেন? নচেত্ তারা কেন সাফাই গাইতে এলেন? তাদের কাছে তা আশা করিনি। কালিমাটি ডাক্তারদের গায়ে ছিল না। কালিমাটির মূলে প্রশাসন। তাই তাদের পক্ষে ডাক্তারদের সাফাই ভালো লাগেনি। তদন্ত চলছে। দেখা যাবে কত ধানে কত চাল! ততদিন অপেক্ষায় রইলাম।
কথাগুলোর অবতারণা করলাম এ কারণে, এখনো ডাক্তাররা যে হারে আক্রান্ত হচ্ছেন কিংবা মারা যাচ্ছেন, তাতে গোটা মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন অনেকে। ডাক্তারিবিদ্যায় কিছু সহজ বিষয় থাকে, তার মধ্যে একটি হলো প্রটোকল। কোন রোগে কী করতে হবে, সেই প্রটোকল ডাক্তারদের জানানোর দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। চার মাসেও তা হয়নি। এরই মধ্যে বাংলাদেশের করোনা পরীক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাপী চমকপ্রদ রসালো আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। করোনা টেস্ট নেগেটিভ নিয়ে চীন, জাপান, কোরিয়ায় ধরা পড়েছেন অনেকে। হয় আমাদের পরীক্ষার নামে ভাঁওতাবাজি চলছে, নচেত্ চলছে বাণিজ্য। মন্ত্রণালয় বিব্রত বোধ করেনি কিংবা বলেনি কাউকে শাস্তি দেয়া হবে। বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা বাড়ছে দেশের এই অব্যবস্থাপনায়। পরীক্ষা করা কিংবা চিকিত্সকদের সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। তারা তাতে ব্যর্থ।
অথচ তাদেরই হাতে গোটা জাতির সুরক্ষার দায়! কতটুকু পালন হবে বোঝা যায়! গত চার মাসেও তারা ঠিক করতে পারেননি নিজেদের দায়িত্বের প্রটোকল, আমি চিকিত্সার প্রটোকল বলছি না। ডাক্তাররা কীভাবে রোগী সামলাবেন, সেটাই তারা বুঝতে পারছেন না। ফলে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন। অথচ এখন বলছেন লাল-হলুদ-নীল রঙের কথা! শুনতে ভালো শোনায় কিন্তু কার্যত ব্যর্থ হতে বাধ্য। মাঝরাতে টিভিতে কিছু চেনা মুখ ডাক্তার আসেন। তাদের মুখেই শুনলাম আরনট বলে নাকি একটি সংখ্যা আছে, তা দ্বারা বোঝা যায় আমাদের করোনা বিস্ফোরণের মাত্রা কেমন। আরনট শূন্য হলে সংক্রমণ শেষ। আরনট ১ হলে সংক্রমণ ও নিরাময় সমানে সমান। আরনট ১-এর বেশি হলে যেমন ২ হলে সংক্রমণ দুই গুনিতক হারে বাড়বে। অর্থাত্ আজ একজন আক্রান্ত হলে কাল হবে দুজন, পরশু হবে চারজন। যখনই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, আমাদের আরনটটি কত? তখনই বলা হচ্ছে, গবেষণা করা প্রয়োজন। গবেষণা ছাড়া বলা সম্ভব নয়। তাহলে ব্রিটিশরা কী করে চট করে বলে ফেলল, তাদের আরনট এখন একের নিচে? বুঝতেই পারছেন আমাদের বিশেষজ্ঞরা কেবল বেদবাক্য আওড়াচ্ছেন। সবই জানেন, তবে কিছু্?ই বুঝতে পারেন না। তাদেরকে বিদেশের বিশেষজ্ঞরা কিছু বলে দিলেই তবে তারা বিশ্বাস করেন। দেশী গরুর দুধ কম, তাই দামও কম। দেশী বিশেষজ্ঞদের তৈরি কিছু এলেই তাদের রেফারেন্স পয়েন্ট সিডিসি।
কথাগুলো বলছি কারণ এরই মধ্যে আমরা বুঝেছি তাদের নিজেদের দেয়া করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট শতভাগ ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গুয়াংজোতে একটি ফ্লাইটের ১৬ বাংলাদেশীর করোনা নেগেটিভ তাদের পরীক্ষায় পজিটিভ হয়েছে। আমাদের নিজেদেরও এসব টেস্টের ওপর বিশ্বাস কম। তাই আমি দেখেছি একই ব্যক্তি দুই-তিন-চার জায়গায় টেস্ট করাচ্ছেন। নেগেটিভ কিংবা পজিটিভ কোনোটাকেই কেউ বিশ্বাস করছেন না। অথচ এই একই কারণে করোনা শনাক্তকরণ দেশী কিট দিনের আলো দেখতে পায়নি। নিজেদের পরীক্ষার সক্ষমতা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ উপস্থাপনের প্রয়োজন এখন।
পরিচিত লোকজনের মধ্যে রোগ ছড়িয়েছে। মারা গেছেও বেশ অনেক। অতএব লুকোচুরির আর সুযোগ নেই। আমরা টেস্ট করতে জানি না। কয়েক দিন আগে আমার এক পরিচিত রোগীর টেস্টকিট হারিয়ে গেছে। অর্থাত্ যারা তা পরীক্ষার জন্য নিয়েছিলেন, তারা তা হারিয়ে ফেলেছেন। এত রোগী বলেই কি? সংখ্যাতিরিক্ত রোগী হলে দু-একটা ভুল হবেই। কিন্তু প্রতিদিনকার সংখ্যা তা বলছে না। সংখ্যা এখনো কম। ১৬-১৭ কোটি দেশের মানুষের মধ্যে দিনে ১২-১৫ হাজার টেস্ট কিছুই না। তবে কেন এই দুরবস্থা? আবারো একই বিষয়—পরীক্ষা করার প্রটোকলই হয়তোবা হয়নি! বিশ্বাস হয় না, তবে না করেও পারছি না। প্রতিদিনকার সংবাদ সম্মেলনে আমরা মুখস্থ কিছু ওয়াজ শুনি। নেই কোনো বিব্রতবোধ। নেই কোনো ব্যাখ্যা। নেই প্রশ্নোত্তর।
এই যখন অবস্থা, তখন তাদের ওপর বিশ্বাস করে জাতিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার কথা ভাবতেই পারছি না। হতাশ হচ্ছি। কিন্তু এই হতাশার মাঝেই আলো দেখাল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালেয়ের অর্থনীতির এক ছাত্রী। নাম তার সুস্মিতা দত্ত। অযাচিতভাবেই সে তার গবেষণা শুরু করল ঘরে বসেই। বাংলাদেশের আরনট কি বের করা যায়? কোনো গবেষণা ফান্ড না নিয়ে কেবল শিক্ষকের সহায়তায় সে প্রকাশিত পরিসংখ্যান দিয়ে বলল যে আমাদের আরনট ১ দশমিক শূন্য ৪, অর্থাত্ একের চেয়ে একটু বেশি। তার গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয় কোনো টাকা খরচ করেনি। আমাদের প্রকাশিত ডাটার অসংলগ্নতা সত্ত্বেও সে ইকোনমেট্রিকসের সাহায্যে তা বের করল। তার গবেষণালব্ধ ফল নিয়ে আরো বিস্তারিত বিশ্লেষণের প্রয়োজন। তবে সংখ্যাটি চিন্তায় ফেলেছে। কারণ? কারণ আমাদের আরনট ১ দশমিক শূন্য ৪, কিন্তু তা কি বাড়ছে না কমছে? নাকি স্থির? তার গবেষণায় দেখা গেল, তা একসময় ৩-এর কাছে ছিল। সেই সময়ই কিন্তু আমরা সবকিছু বন্ধ করেছিলাম। সিদ্ধান্তটি খারাপ ছিল না। অথচ এখন অনেকেই তার সমালোচনা করছেন। বলছেন, তখন বন্ধ না দিয়ে এখন দেয়া উচিত। আবার গবেষণায় এটিও দেখা যাচ্ছে যে আমাদের রেখাটি এখনো ঊর্ধ্বগামী। মাথা হেট হয়ে গেল তার কাছে, কারণ একটি মাস্টার্স পড়া ছাত্রী কাজটি করেছে আর আমাদের বিজ্ঞজনেরা সারা রাত টিভিতে রাজা-উজির মারছেন! আমাদের প্রধানমন্ত্রী মাঝেমধ্যে সত্যি কথাটি বলেন। তিনি একসময় বলেছিলেন, রাতভর টিভিতে বসে যারা গালগপ্প করেন, তারা সম্ভবত সুস্থ মানুষ নন। এখন কারা সেখানে বসে সময় কাটান, তা দেখার মতন।
ফিরে আসি পরিসংখ্যানে। প্রকাশিত পরিসংখ্যান সঠিক না হলে, করোনা টেস্ট সঠিক ফল না দিলে, চিকিত্সকরা সঠিক সুরক্ষা না পেলে কী করে আমরা এই অবস্থা থেকে বের হতে পারব, তা বলা মুশকিল। কারণ আমরা সবাই আন্দাজে কথা বলি। গবেষণা দ্বারা কথা বলি না। গবেষণা আমাদের রন্ধ্রে নেই। সেদিন এক সাংবাদিক এক রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, আপনার মাস্ক কই? সে উত্তর দিল আছে—বলে সম্মান প্রকাশের জন্য তা মুখে লাগাতে লাগল। সাংবাদিক সরে যাওয়ার পরই সে বলতে লাগল, ‘বড়লোকের ব্যারাম!’ অর্থাত্ করোনা সাধারণ লোকের হয় না। সত্যি না মিথ্যে জানি না, তবে সেও আন্দাজে কথা বলছে। তাই টিভিতে বসে তার সুরে মানে আন্দাজে কথা না বলাই ভালো। সারা রাত টিভিতে না কাটিয়ে গবেষণা করুন। জানতে চেষ্টা করুন কেন আমাদের এত ডাক্তার বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন? যতদিন পর্যন্ত ডাক্তারদের মৃত্যু আমরা ঠেকাতে না পারব ততদিন পর্যন্ত বিশ্বাস করা কঠিন হবে যে আমরা রোগীদের চিকিত্সা দিয়ে বাঁচিয়েছি। পানিপড়া দিয়েও এই সংখ্যক রোগী অনেক সময় বেঁচে যায়। কৃতিত্ব ডাক্তারের নয়। কৃতিত্ব রোগীর। তার অসীম মানসিক শক্তিতে সে করোনাজয়ী হয়েছে। পানি পড়া, ঝাড়ফুঁক সেই মানসিক মনোবল বাড়ায়। জানতে চেষ্টা করুন, কেন আমাদের টেস্ট বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। দোষ কি মার্কিনি সিডিসির, নাকি আমাদের অব্যবস্থাপনার? তার ওপর টেস্টের ফি বসানো হয়েছে। তার কত শতাংশ কে পাবেন সেই হিসাব কি কখনো বের হবে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনায় আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে আমরা উন্নত দেশ হতে চলেছি। এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী কে? এখনো অনেক জেলা শহরে সঠিক মানের চিকিত্সা ব্যবস্থা কেন গড়ে ওঠেনি? সবাই কি ভেবেছিলেন যে সিঙ্গাপুর চলে যাবেন? অব্যবস্থাপনার আঙুল সঠিক দিকে না দিলে সরকারের দিকে ঘুরে যাবে। কথায় বলে সাবধানীর মার নেই। বিষয়টি ভেবে দেখুন।
সব শেষে আমার নিজের কয়েকটি প্রশ্ন। দেখা যাচ্ছে যে যেসব অফিসে লোকসমাগম রয়েছে, সেখানেই আক্রান্ত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত। ব্যাংক একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ছোঁয়াচে রোগের নিয়মই তা-ই। কে আসছে কে যাচ্ছে, কেউ জানে না। একজন ভাইরাসটি নিয়ে ভেতরে এলে ব্যাংকের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে তা থেকে গেলে বদ্ধ ঘরে কিংবা ফ্যানের বাতাসে তা কি সবার কাছে চলে যায়? পৃথক কক্ষে বাস করার পরও একই বাসার অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছে কেন? ফ্যান কিংবা শীতাতপ যন্ত্রের কারণে কি? গরিব লোকজন যাদের বাসায় ফ্যান নেই বা যারা কর্মক্ষেত্রে আবদ্ধ পরিবেশে থাকে না, তাদের মধ্যে আক্রান্তের হার কি সত্যিই কম? সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে পৃথকীকরণ যুগ যুগ ধরে একটি সাধারণ নিয়ম। তাই দেখবেন স্কুল-কলেজের কোনো ছাত্রছাত্রী যেকোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে আমরা তাকে ঘরে থাকতে বলি। করোনার ক্ষেত্রে প্রধান অসুবিধা হলো লক্ষণবিহীন রোগী। তাই বলা যায় না কে আক্রান্ত আর কে আক্রান্ত নয়। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের আচার-আচরণের ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। কী করলে আমাদের আচরণ বদলাবে, তার কোনো গবেষণালব্ধ ফল রয়েছে কি? কিংবা অনেক দেশে দেখা যাচ্ছে মাছ কিংবা মাংসের বাজারে রোগটির আক্রান্তের হার বেশি। অনেক ক্ষেত্রেই কিন্তু এসব স্থান শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তাহলে কি ভাইরাসটি আমাদের ঘরের ফ্রিজেই বসে থাকে অনেকদিন। অসাবধানতাবশত তা থেকেই কি ছড়াচ্ছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা উচিত। আক্রান্তের হার কি সেসব বাসায় বেশি, যারা ফ্রিজে রাখা খাবার পূর্ণতাপে গরম না করে বা মাইক্রোওভেনে গরম করে খাচ্ছেন?
বছর ছয় আগে আমি একটি গবেষণা করেছিলাম এক ছাত্রীকে নিয়ে। কী করলে মানুষ হাত ধুতে উত্সাহী হবে? মীনা কার্টুন দেখালে? নাকি বাসায় বাসায় গিয়ে বুঝিয়ে এলে? নাকি বাসায় বাসায় পোস্টার সেঁটে দিয়ে এলে? প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের খরচ এক নয়। সবচেয়ে কম পোস্টারে। দেখা গেল যাদের বাসায় আমরা পোস্টার সেঁটে দিয়ে এসেছিলাম, তাদের ক্ষেত্রে হাত ধোয়ার প্রবণতা বেড়েছে। আমাদের প্রচলিত ধারণার উল্টোটি! আমরা ভেবেছিলাম মীনা কার্টুন বা টিভির প্রচার কাজে লাগবে। তাই বলছি প্রকৃত গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রকাশ করুন। গবেষণা করুন। বিশেষভাবে অজ্ঞ না হয়ে বিশেষজ্ঞ হোন।
শেষ করি সেই গল্প দিয়ে। বাসায় শিশুটি অসুস্থ। বাবা-চাচারা সবাই উদ্বিগ্ন। কেউ বলেন, ডাক্তার ডাকো। কেউ বলেন, কবিরাজ ডাকো। কেউ বলেন, মন্ত্রজপ করো। বিশ্বাস দিয়ে নয়, গবেষণার ঝুড়ি থেকে উত্তর বের করুন। সবাই আন্দাজে কথা বললে তা শেষ পর্যন্ত দেশের জনগণের জন্য কাল হবে। সরকারের জন্য তো বটেই।
ড. এ. কে. এনামুল হক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি