মঙ্গলবার | নভেম্বর ১০, ২০২০ | ২৫ কার্তিক ১৪২৭

গ্রামীণ রূপান্তর || সমাজ

গ্রাম বদলেছে, এখন দরকার আদর্শ গ্রাম

ড. এ কে এনামুল হক

আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর, 

থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর\ 

আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান, 

আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচায় যে প্রাণ। 

মাঠে ভরা ধান আর জল ভরা দিঘী, 

চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি। 

গ্রামবাংলার এ চিত্র এখন কি কেবল কবির মনেই রয়েছে? কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম যশোর অঞ্চলে। শীত তখনো যায়নি। ভাবলাম খেজুরের রস খাব। যাকেই জিজ্ঞেস করি, সবাই না বলে। ও এখন খাবার যোগ্য না। গবেষেণা দলের সব সদস্যেরও একই কথা—স্যার খেজুরের রস খাওয়া যাবে না। বাসা থেকে না করে দেয়া আছে। কেন? স্যার, জিকা ভাইরাস! খাওয়া যাবে না। আমিও নাছোড়বান্দা। এরা সবাই আমার ছাত্রছাত্রী, শহরের ছেলেমেয়ে। আমার এক সহকর্মীও সঙ্গে। সেও ঢাকার মেয়ে। গ্রামবাংলা দেখেনি। তার সাফ কথা, স্যার আমি খাব না। কিন্তু রসই পাচ্ছি না আর খাওয়া! কোথায় সেই রসওয়ালা। অনেক খোঁজাখুঁজি করে প্রায় চার-পাঁচদিন পর একদিন সন্ধ্যায় দেখি এক লোক একটি হাঁড়ি নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল হাঁড়িতে রস। সঙ্গের সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিল। আমরা কয়েকজন এক গ্লাস খেলাম। বললাম আরেক গ্লাস দাও। ততক্ষণে আমার সহকর্মীও যোগ দিলেন। বললেন, বাসায় বলা যাবে না। শেষ পর্যন্ত এক গ্লাস নয়, দু?ই গ্লাসই গলাধঃকরণ করলেন তিনি! এবার আমার মাথায় চাপল রস কী করে সংগ্রহ করে দেখব। হাঁড়িওয়ালা খুঁজতে থাকলাম। কোথাও পাওয়া গেল না। একদিন-দুদিন করে তৃতীয় দিনে কেমন করে যেন আমরা ভুল করে গ্রামের পথে চলে গেছি। দেখি এক বৃদ্ধ হাঁড়ি নিয়ে খেজুরগাছে উঠছে। আর যায় কোথায়। তাকে নিয়ে ছবি তুলতে সবাই লেগে পড়ল। কী করে রস ভাঙা হয়। একা একজন লোক মাটির হাঁড়ি পিঠে নিয়ে, রস কাটার যন্ত্রপাতি নিয়ে তরতর করে উঠে গেলেন! অথচ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি হয়তোবা সোজা হয়ে হাঁটতেও পারবেন না! নামার পর জানলাম তিনি একা প্রায় ১৪৫টি গাছে রস ভাঙেন। এটিই তার আয়। সঙ্গে কেউ নেই? না, আমি একাই করি। ভয় করল। যদি পড়ে যান! ছেলেমেয়ে আছে? তা আছে, তবে তারা কেউই এ কাজে উৎসাহী নয়। এ কাজ তারা করবে না। আমিই শেষ। 

বুঝতেই পারছেন। গ্রামবাংলা পরিবর্তিত হচ্ছে। একদিন যে গ্রামের পথে ‘হট হট’ করে গরু নিয়ে লোকজন যেত, আজ সেখানে চলছে ভটভটিয়া। ফসলের মাঠে গরুর পদচারণা নেই বললেই চলে। গরুর বদলে এসেছে ট্রাক্টর। ধান মাড়াই প্রায় অচল। কোথাও পাবেন না। আমাদের এক প্রজন্মেই এত পরিবর্তন লক্ষ করার মতো। তবে তাই বলে গরুর সংখ্যা কমেনি। গরুর ব্যবসা আর গরু দিয়ে হাল চাষ এক নয়। গরুর খামার। দুধের খামার। একবার গেলাম পাবনায়। অজ পাড়াগাঁয়ে। তবে গাড়ি করে। গ্রামের প্রায় প্রতিটি রাস্তায় এখন গাড়ি চলে। গাড়ি থেকে নেমেই এক খামার। খামারি একজন স্কুলশিক্ষক। স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। গরু মাঠে নেই। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন চলছে খামার? বেশ কষ্ট। কেন? কাজের লোক পাওয়া যায় না। গরুর খামারে কাজ করতে এই যুগে মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। তার কথার সত্যতা রয়েছে। তিনি বললেন, কোনো একজন লোক অনুপস্থিত হলেই আমাকে কাজ করতে হয়। গরুর খামারের কাজ তো অফিসের মতন নয় যে আগামী দিন করা যাবে? প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন করতে হয়। খামার বাঁচানো যাবে না। 

গবেষণার কাজে যাচ্ছিলাম কক্সবাজার। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। রাস্তায় গাড়ি থামালাম। কারণ? হঠাৎ করেই চোখে পড়ল ড্রাগন ফলের বাগান। পাহাড়ের কোণে এক কৃষক ড্রাগন ফল চাষ করেছেন। একসময় এ দেশে ধানক্ষেতে সারি করে ধান লাগানোর জন্য হয়েছে মাসের পর মাস প্রশিক্ষণ। সেই দেশের কৃষক এখন জানেন কী করে ড্রাগন ফল চাষ করতে হয়। 

আশির দশকে আমরা ছাত্রছাত্রীরা গিয়েছিলাম সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। সেখানে যাওয়ার কাহিনী শুনলে আঁৎকে উঠবেন। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বার্ষিক শিক্ষাসফরের আয়োজন চলছে। সবাই মিলে ভাবলাম রাজশাহী যাব। প্রায় সব তৈরি। তখন আমার এক বন্ধু বলল, চল আমরা সেন্ট মার্টিনে যাই। রাজশাহী আমরা জীবনে আরো যেতে পারব কিন্তু পরিবার কখনো আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নিয়ে যাবে না। এতটা দুর্গম ছিল এ দ্বীপ! বলাবাহুল্য আমার এই বন্ধুটি তখন বিবাহিতা। মেয়েদের সবার ধারণা এটা একটা বিশেষ সুযোগ। চলো যাই। তাই ঠিক হলো সেখানে যাব। বাসে করে চট্টগ্রাম থেকে গেলাম কক্সবাজার। সেখান এক রাত থেকে পরদিন ভোরবেলা গেলাম টেকনাফে। সেখানে গিয়ে জানলাম, দ্বীপে যাওয়ার নৌকা ছেড়ে গেছে সকাল ৭টায় আর কোনো নৌকা নেই। সবাই হতাশ। আমাদের হতাশা দেখে সেখানকার তত্কালীন বিডিআরের এক অফিসার জানালেন, তোমরা যদি কাল সকালে আস তবে আমি নৌকা ঠিক করে রাখব। খুশিতে আত্মহারা আমরা। যাওয়ার সময় আমাদের নৌকায় এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। কোথায় যান? সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আমি বাস করি। কী করেন ওখানে? স্কুলে পড়াই। কেমন জীবন। ছয় মাস আমরা মূল ভূখণ্ডে আসতে পারি না। কীভাবে দৈনন্দিন জিনিসপত্র সংগ্রহ করেন? আগেই আমরা সংগ্রহ করে থাকে আর যদি মাছের নৌকা কখনো টেকনাফ আসে তবেই কিছু জিনিসপত্র যায়। চলে আসি ২০২০ সালে। ছাত্র নিয়ে যাচ্ছি সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। সাগরের সঙ্গে মানুষের জীবিকার সম্পর্ক নিয়ে ছাত্রদের জানাতে সেখানে যাওয়া। সেখানে সাগরপাড়ে জৌলুশ চোখে পড়ার মতো। কী নেই। আমরা খোলা আকাশের নিচে রাতে বারবিকিউ করে খেলাম। থাকার ব্যবস্থাও চমত্কার। পালের নৌকা নাই। কাঠের নৌকা কেবল জেলেদের জন্য। বিচে সাইকেল কিংবা মোটরসাইকেল চালাতে চান ভাড়ায় পাবেন। সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের অজ পাড়াগাঁয়ের একটি অংশ ছিল। অথচ এখন ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবস্থা রয়েছে। আপনি চাইলে সেখানে ডুবো জাহাজে করে সাগরতলে প্রবাল দেখতেও যেতে পারেন।

নব্বইয়ের দশকে গিয়েছিলাম কান্তজির মন্দির দেখতে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজেই ঠাকুরগাঁও গিয়েছি। ফেরার পথে কান্তজির মন্দির দেখতে যাই। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই—চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার! মন্দিরের সামনেই একটি ছোট গ্রামের বাজার। টিমটিম করে কেরোসিনের কুপির বাতিতে তখনো বাজার চলছে। আমরা কোনো রকমে মন্দিরটি দেখতে পেলাম। অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম কিন্তু আর নেই। দেখবেন আলোর ঝলক! কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম খালশি বাজারে। বেনাপোলের দক্ষিণে পুটখালির কাছে এ গ্রাম। ভারতের গা ঘেঁষা এ গ্রামে গিয়ে দেখলাম এক অবাক কাণ্ড। গ্রামের লোকজন বাঁওড়ের পানি শোধন করে বাড়ি বাড়ি পাঠাচ্ছে। জাপানি সরকারের সহায়তায় তৈরি এ প্রকল্পের মেয়াদ বহু আগেই শেষ। কিন্তু গ্রামবাসী নিজেরাই তা রক্ষণাবেক্ষণ করছে। কোনো ওয়াসার মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হয়নি। গ্রামবাংলার এই চিত্র মনে রাখার মতো। পাশেই ছিল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষক মানুষ তাই ভাবলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেখে আসি। সেখানে গিয়ে পেলাম প্রধান শিক্ষককে। বিশাল মাঠ স্কুলটির। মনোরম পরিবেশ। ডিসেম্বর মাস। তখন স্কুলের ছুটি চলছে। প্রধান শিক্ষক অত্যন্ত অমায়িক ব্যক্তি। আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন তার কক্ষে। তার কক্ষে একটি মানচিত্র। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম তার স্কুলের ছাত্ররা কোন কোন গ্রাম থেকে আসে তার মানচিত্র। একটি করে নাম্বার রয়েছে। কী ওগুলো। বাড়ির নাম্বার। কোন কোন বাড়ি থেকে ছাত্র আসছে তার চিহ্ন। কী করেন তা দিয়ে? আজকে আমার শিক্ষকেরা গিয়েছে ওই সব বাড়িতে। সবাই ভাগ ভাগ করে নিয়েছে গ্রাম। দেখছে সেখানে এমন কোনো শিশু রয়েছে কিনা যে স্কুলে পড়ছে না। তাদের স্কুলে নিয়ে আসতে তারা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। গ্রামের এ চিত্র হয়তো সর্বত্র নেই। তবে যেখানেই তার মতন শিক্ষক রয়েছেন সেখানেই এ উদ্যোগ। 

মেহেরপুরের মুজিবনগরে গেলাম। যাওয়ার পথে দর্শনার কাছে উথালি বাজার। গ্রাম্য বাজার। কিন্তু রয়েছে সোনালী ব্যাংকের শাখা। রয়েছে বিশাল গ্রামীণ বাজারের কাঠামো। উঁচু ভিটাসহ টিনের চালা। খোলামেলা স্থান। কিন্তু বাজারটি রয়েছে রাস্তার পাশে। কী ব্যাপার এত সুন্দর চালাঘর থাকা সত্ত্বেও বাজারটা কেন রাস্তার পাশে? রাস্তা বন্ধ করে? কমিটিতে গন্ডগোল। তাই বাজার চলছে না। সরকারের গোটা বিনিয়োগ এখন ছাগলের আবাসস্থল! হায় আমাদের রাজনীতি! বলেছি পুটখালির কথা। সেখানেও রয়েছে একটি বাজার। বাজারের রাস্তাটি কাদামাখা। বাকি সব রাস্তা সুন্দর। বাজারে হাঁটা যায় না। অথচ বাজারের পাশেই কিন্তু একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ রাস্তাটা এমন কেন? রাস্তায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। রাস্তা যে মন্ত্রণালয় তৈরি করে ড্রেন কি অন্য মন্ত্রণালয় তৈরি করে? রাস্তার পাশে ড্রেন তৈরি করার জন্য কি আরেকটি টেন্ডার লাগবে? কেন রাস্তা তৈরির সময় ড্রেন তৈরি হলো না? তাহলে রাস্তা কাটার জন্য একটি নতুন ঠিকাদার লাগবে? এসব প্রশ্ন এখন গ্রামের মানুষের মনে। বলেছিলাম পাশের গ্রামেই কিন্তু খাবার পানির সুবন্দোবস্ত রয়েছে নিজেদের প্রচেষ্টায়। সরকার এলেই কি বিপদ হয়?

যাচ্ছিলাম জেহালায়। চুয়াডাঙ্গা থেকে উত্তরের একটি গ্রাম্য বাজার। আমার সঙ্গে বেশ কজন সরকারি কর্মকর্তা। বাজারের কী উন্নয়ন করা যায় তা নিয়ে তাদের যত চিন্তা। পথে আরেকটি বাজার। রাস্তার পাশে আলুক্ষেত। চাষীরা বস্তায় ভরছেন আলু। ট্রাকে করে তারা পাঠাবেন। মোড় ঘুরতেই চোখে পড়ল অগ্রণী ব্যাংকের শাখা। সমৃদ্ধ অঞ্চল। চোখে পড়ল একটি গুদামঘর। বিশাল স্থাপনা। কার গুদাম? সঙ্গের কর্মকর্তাকে ইতস্তত মনে হলো। আমাদের স্যার। কী রাখা হয়? কিছুই না। কাজ করেনি। সরকারি বিনিয়োগের এ অবস্থা! চারদিকে তাকালাম। সেই গ্রাম আর নেই। চারতলা-পাঁচতলা ভবনও দেখা গেল কয়েকটি। 

দর্শনা থেকে কাপাসডাঙ্গার পথটি মনোরম। চমত্কার খোলা জায়গা। এক পাশে ফসল, অন্য পাশে বিশাল বিল। মাছের উৎপাদনস্থল। এখান থেকে মাছ চলে যায় যশোরে, খুলনায়। কীভাবে নেয়? বরফ দিয়ে? না জীবিত মাছ যায়? কী করে যায়? অক্সিজেন ট্রাকে স্যার! ড্রাইভারের উত্তর। বোকা বনে গেলাম। এ অজ পাড়াগাঁয়ে অক্সিজেন গাড়ি? কেমন দেখতে। এখনই দেখবেন স্যার! পাশ দিয়ে একটি ভটভটিয়া গেল। এ অঞ্চলে এর অনেক নাম রয়েছে। কেউ বলে আলম সাধু, কেউ বলে নছিমন, কেউ বলে করিমন। তবে নতুন একটা নামও পেলাম—লতাহামপাক! সবগুলো এক নয়। মনে হবে এক। কিন্তু তা নয়। বিভিন্ন কাজের গাড়ির বিভিন্ন নাম। অনেকটা টয়োটা, মারুতি, ফোর্ড ইত্যাদির বিভিন্ন মডেলের মতো। পেছনে একটা ট্যাংক। এই যে স্যার অক্সিজেন গাড়ি? ভাবলাম গ্রামবাংলার মানুষ হয়তোবা নাম দিয়েছে। আসলে একটি ছোটখাটো ইঞ্জিনচালিত ঠেলা। কিন্তু ভুল ভাঙল যখন কাছে গিয়ে দেখলাম। ৭০-৮০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত যাওয়ার পথে মাছ যেন না মারা যায় তাই প্রতিটিতে রয়েছে একটি করে অক্সিজেন সিলিন্ডার! তা থেকে নিয়মিত পানির ট্যাংকে অক্সিজেন সাপ্লাই করে। রীতিমতো সায়েন্স ফিকশন। তাও এই গ্রামে!

যশোর থেকে যাচ্ছিলাম ভবদহে। সেখানে রয়েছে বিশাল মাছের বাজার। স্থানীয় কলেজের উদ্যোগে তৈরি এ মাছের বাজারে দূর-দূরান্ত থেকে মাছ নিয়ে আসেন অক্সিজেন ট্রাকে। দুপুর ১২টায় বাজার থাকে তুঙ্গে। অতঃপর তিনটার দিকে শেষ হয়। বিশাল হলঘরে চলছে মাছের ডাক। মাছ ব্যবসায়ীরা এখানে চাষের মাছ কেনে পাঠিয়ে দেন দূর-দূরান্তরে। এখানকার মাছ নাকি চলে যায় সিলেটে, চট্টগ্রামে। পাইকাররা মোবাইলে অর্ডার দিচ্ছেন। আড়তদার ডাক দিয়ে কিনছেন। অতঃপর রয়েছে নানা ব্যবস্থা। মাছকে বিভিন্ন ধরনে ভাগ ভাগ করে বরফের আস্তরে ঢেকে বাক্সবন্দি করে পাঠানো হবে এসব জেলায়। বিশাল কাজকারবার। কে চালায়? সরকার? না, তা নয়। কলেজের ব্যবস্থাপনায় চলছে এ কাজ। পথে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম খোলা জায়গায় মোজাইক করা একটি স্থান। থামলাম। লেখা রয়েছে মাছের বাজার। কেউ নেই। আমরা থামতেই লোকজন এগিয়ে এলেন। কী ব্যাপার? না, আমরা জানতে চেয়েছি এ মাছ বাজার এখানে কেন? সরকার করেছে! হাটবার কবে? কখনই চালু হয়নি? কবে তৈরি করা হয়েছে? এক বছর বা বেশি সময় হবে! সরকারি ব্যবস্থা? হুম। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমরা চলে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়িতে। গ্রাম বলতে জমির আইল ধরে বাঁশের সাঁকো দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়িতে। ওখানে এই বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে অন্তত পাকিস্তানি সেনারা আসতে সাহস পাবে না। সেই গ্রাম ছিল ছায়ায় ঘেরা। নীরব। সপ্তাহে দুদিন ছিল হাটবার। অন্যদিন বাড়িতে বসে থাকা। হাট বলতে ছিল কাদামাখা একটি কেন্দ্র। কিন্তু ছিল মজার স্থান। কত রকমের খাবার পাওয়া যেত। দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসত। কয়েক ঘণ্টার ব্যবস্থা। যেতে হতো হেঁটে। ছোট ছিলাম তাই যেই বাজারে যেতেন তার সঙ্গে চলে যেতাম। অনেকে উৎসাহ ভরেই নিয়ে যেতেন। কেউ কেউ ছিলেন, যেতেন মাছ ধরতে। আমিও শরিক হতাম। আমার ছোট ভাই সেও যেত। কিছুদিন পর বুঝতে পেলাম, আমার বড়শিতে মাছ আসে না। সবই তার বড়শিতে। আমার বেজার মুখ দেখে দাদারা বলতেন, তুমি ওর জায়গায় যাও। কিন্তু না, তাতেও কাজ হয় না। মাছ আমার ছোট ভাইয়ের বড়শিতেই যায়। আজও তার কারণ খুঁজে পাইনি। বেশ কয়েক বছর আগে আমি গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জে এক গ্রামে। ছাত্রদের নিয়ে। গ্রামবাংলা না দেখে পাস করে গেলে তারা বাংলাদেশের চেয়ে আমেরিকাকে বেশি ভালোবাসবে! জানুক আমাদের দেশকে। কথা বলছিলাম এক বাড়িতে। গরিব ঘর। মহিলা কথাচ্ছলে বললেন, শীতকালে তার স্নান করার সুযোগ বেশি হয় না। কেন? কারণ গ্রামে এখন পুকুর নেই। যা আছে তাতে হয় মাছ চাষ। তাই স্নান করা মানা। নদীনালা? শীতকালে প্রায় শুকিয়ে যায়। যেটুকু পানি থাকে তাতে পানি থাকে না। থাকে ময়লা-আবর্জনা। বুঝতে পারলাম গ্রামীণ অর্থনীতি বদলেছে। এখন প্রয়োজন আদর্শ গ্রাম তৈরি। যেখানে থাকবে আবর্জনা রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা। জিজ্ঞেস করলাম, নলকূপ? সরকারের দেয়া এতগুলো নলকূপ? আছে। তবে ওগুলো এখন যার জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে তাদের ব্যবহারে। আমরা কেবল খাবার পানি আনতে পারি।

দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার কথা সবাই জানেন। গিয়েছিলাম কয়রায়। আইলার আঘাতে বিপর্যস্ত গ্রাম। ভাবলাম ছাত্রদের নিয়ে দেখিয়ে আসি কী করে আমাদের গ্রামবাসী বাস করছে লবণাক্ত অঞ্চলে। সেখানে যাওয়ার পথে দেখতে পেলাম জলাবদ্ধতা। কপোতাক্ষ নদের পানিতে গ্রাম ডুবে আছে। কীভাবে। নদীর খনন হয়নি অনেকদিন। নদীর তলানি গ্রামের উচ্চতার সমান। তাই পানি এলেই গ্রামটি ডুবে যায়। কপোতাক্ষ নদ অনেকটা মরা। পানি না থাকায় পলি জমে জমে এ অবস্থা। তারপর গেলাম চালনায়। চালনা বন্দরের নাম স্কুলের বইতে পড়েছিলাম। কোনোদিন দেখতে পাইনি। তাই সুযোগ হারানো যাবে না। চালনার দক্ষিণের গ্রামগুলো একটু ভিন্ন রকম। বহুদিন পর গোলা দেখতে পেলাম। হারিয়ে গিয়েছে ধানের গোলাগুলো। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে উঠানের এক পাশে গোলা দেখতে পেলাম। সব রাস্তা পাকা। গ্রামের লোকজনকে নিয়ে কথা বললাম। গোলা যেহেতু রয়েছে তাতে মনে হচ্ছে ধান হয়। বোরো ধান দেখছি না যে? লবণাক্ততার জন্য করতে পারছেন না? না তা নয়। তবে কি? আমাদের গ্রামের খালগুলোতে পানি ধরে রাখা হয়। সেখান থেকে আমরা সেচ দিই। তাতে বোরো ফসল সম্ভব। তবে? কৃষি বিভাগ আর মত্স্য বিভাগ দুই মন্ত্রণালয়ে। তাই পানির ওপর আমাদের অধিকার নেই। কী বলেন? কার অধিকার রয়েছে? স্যার মত্স্য বিভাগের অধিকার! তো? ওরা খালগুলো লিজ দিয়েছে মাছ চাষের জন্য, তাই পানি আমাদের নাগালের বাইরে।

চুয়াডাঙ্গার কালো ছাগল নামকরা। সেখানে গেলে স্থানীয় এক প্রকৌশলী বললেন, স্যার ছাগলের মাংস খেয়ে যাবেন। আচ্ছা ছাগল-গরু কোথায় বিক্রি হয়? এখানে গরুর বাজারগুলো দেখার মতো। আপনাকে নিয়ে যাব। গেলাম গরুর বাজার দেখতে। খোলা মাঠে গরুর বাজার। বাজারে গিয়ে বুঝলাম অনতিদূরে আরেকটি বাজার রয়েছে। দুটি বাজার এত কাছাকাছি কেন? এখানে গরুর বাজারে আয় অনেক। এটা তো শহরের মধ্যে এখানে কেন? একজন জায়গাটি দান করেছেন। কী জন্য? গরুর বাজারের জন্য। এত দামি জায়গা তিনি দান করেছেন? একজনের মুখে মুচকি হাসি দেখতে পেলাম। আসলে স্যার এখানে খাস জমির পরিমাণ কম ছিল তাই তিনি তার জায়গাটি দান করেছেন। কী দরকার ছিল? আরেকটি গরুর বাজার তো রয়েছে? আসলে এখানে বাজারের ডাক যিনি পাবেন তিনি কোটিপতি হবেন। তাই। ডাকটি কে নিলেন? জমির মালিক নিজেই? কী করে? তার চাচা উপজেলা চেয়ারম্যান। বুঝতে পারলাম গ্রামীণ অর্থনীতির রাজনীতি সমৃদ্ধ! পথে আরেকটি গরুর বাজার দেখতে পেলাম। এলাহি কাণ্ড। হাজার হাজার গরু। করিমন, নছিমন, আলমসাধু ভর্তি করে গরু-ছাগল আসছে। কোথায় যায় এগুলো? সারা দেশে। প্রতি জেলার ট্রাক আসে হাটবারে। গরু কিনে আড়তদাররা পাঠিয়ে দেন। তুলে দেন ট্রাকে। চলে যায় যে যার দেশে।

গ্রামীণ অর্থনীতির বিবর্তন তুলে ধরার জন্যই আজকের লেখা। আশা করি দেখতে পেয়েছেন সরকারি দপ্তরগুলোর সঙ্গে জনসাধারণের সংযোগহীনতার চিত্র। যেটুকু পরিবর্তন হয়েছে তাতে সরকারের সহায়তা যে নেই তা বলা যাবে না। তবে তাদের দুঃখের সঙ্গেও সরকারি ব্যর্থতা জড়িত। অথচ দেশের বিপদে আমরা এ গ্রামীণ অর্থনীতিতেই ভরসা রাখি। সরকারি দপ্তরগুলোর সমন্বয়হীনতার প্রধান কারণ ঢাকাকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত গ্রহণে গ্রামীণ জনগণের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি। নচেত গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। আশা করি সবাই ভাববেন।


ড. এ কে এনামুল হক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন