বৃহস্পতিবার | ডিসেম্বর ১৭, ২০২০ | ২ পৌষ ১৪২৭

সম্পাদকীয়

বিশ্লেষণ

দেশপ্রেমের অর্থনীতি

ড. এ. কে. এনামুল হক

বেগমপাড়ার গল্প শুনতে শুনতে অনেকে হয়তো ভেবেছেন যে সত্যি সত্যি বেগমপাড়া বলে কানাডায় কোনো জায়গা রয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের দেশে টকশোয় বেশ কয়েকজন বলেই ফেললেন যে তারা কানাডায় বসে কোথাও শোনেননি কোথায় বেগমপাড়া রয়েছে! বলিহারি সব জ্ঞানী ও গুণীজন। সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ বিষয়ে সরকারকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দিয়েছেন। পত্রিকান্তরে তা প্রকাশিত হওয়ার পর পরই বিভিন্ন টকশোয় কথার ফুলঝুরি এসেছে। বিজ্ঞজনরা নানা যুক্তি দিয়ে বলেছেন যে এমন পাড়ার নাকি কোনো অস্তিত্বই নেই। এটা সিনেমার একটি কাল্পনিক কাহিনী। আরো বলেছেন যে বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তিনি বলেছেন, তার তথ্যমতে ২৪ বা ২৮ জনের যে তালিকা (আমি টকশোতেই শুনলাম), তাতে মাত্র চারজন রাজনীতিবিদ। অর্থাৎ বোঝা গেল রাজনীতিবিদদের চেয়েও অধিক দুর্নীতিগ্রস্ত লোক সমাজে রয়েছে। গুণীজনের রাগ সেখানেই। তাদের ধারণা কেবল রাজনীতিবিদরাই দুর্নীতিগ্রস্ত। অতএব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন সাফাই গাইলেন রাজনীতিকদের পক্ষে? দুর্নীতিতে মধ্যমণি হচ্ছেন রাজনীতিকরা। তার পরই রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর সরকারি কর্মচারী তাদের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্তের সংখ্যা হাতেগোনা।  

কথাগুলো বলছি এজন্য যে গুণীজনদের এই সাফাই গাওয়াটা কাম্য ছিল না। মূল কথা, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তালিকা চাইছে। তালিকাটা কে তৈরি করবে, সেটাই দেখার বিষয়। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দলগতভাবে সবাই অন্যকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করবে। অতএব, সত্য প্রকাশিত হবে কিনা, তা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাবে। টিভিতে আলোচকদের মধ্যে আইনজ্ঞও ছিলেন। তিনি জানালেন, আইনগতভাবে এই তালিকা নাকি সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে পাওয়া যাবে, আর সেই সঙ্গে টাকাও নাকি ফেরত আনা যাবে। তেলেসমাতির কথা!  কোনো দেশই সহজে দুর্নীতির টাকা ফেরত দেবে না। প্রমাণ ছাড়া। ইমেলদা মার্কোসের টাকা ফিলিপাইন পায়নি। ইদি আমিনের টাকা উগান্ডা পায়নি। ইরান শাহের টাকা পায়নি। হাজারও উদাহরণ দেয়া যাবে ইতিহাস থেকে। তবে আলোচনায় কিছু সত্য কথা ছিল। তা হলো: ১. দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। ২. টাকা যাচ্ছে নানা দেশে। তবে দেশ থেকে পাচার করা সব টাকাই কি দুর্নীতির? বিষয়গুলো খোলসা করার জন্যই লেখা। 

প্রথমত, পৃথিবীর সব দেশ থেকেই টাকা পাচার হয়। শত শত বছর থেকে তা চলে আসছে। রাজারা টাকা পাচার করেছেন। পারিষদরা করেছেন। জেনারেলরা করেছেন। ব্যবসায়ীরা করেছেন। টাকা পাচার নিয়ে পৃথিবী কখনো মাথা ঘামায়নি। তথাকথিত অর্থ পাচারবিষয়ক বর্তমান আন্তর্জাতিক আইন বিশ্বে জোরদার করা হয়েছে টাকা পাচার রোধ করার জন্য নয়। আইনটি করা হয়েছে ওসামা বিন লাদেনের মতো লোকজনকে ধরার জন্য বা তাদের সম্পদ ক্রোক করার জন্য। অতএব, এ বিষয়ে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোকে সাধুবাদ দেয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের হিপোক্র্যাসিটা ওখানেই। অর্থ পাচার রোধে এ আইন করা হয়নি। যদিও নাম রাখা হয়েছে অর্থ পাচার রোধক আইন। আসলে আইনটি করা হয়েছে পৃথিবীতে ইসলামতন্ত্র রোধে তাদের মদদদাতাদের ধরতে। 

বলছি এ কারণে, এখন অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন যে পৃথিবীতে আর দুর্নীতি থাকবে না! বিষয়টি আদৌ তা নয়। সুইস ব্যাংক এখনো নাম ছাড়া অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে। নাম থাকলেও তা থাকে অপ্রকাশিত। সবার আড়ালে। পৃথিবীর সব উন্নত দেশ ব্যাংকে রাখা তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করে। পানামা, ভার্জিন আইল্যান্ড, বারমুডার মতো দেশের সঙ্গে তাদের কোনো সংঘাত নেই। সংঘাত কেবল মুসলিম দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে। আমাদের মতো দেশগুলো ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশই ব্যাংকে দেয়া ব্যক্তিগত তথ্য কারো সঙ্গে শেয়ার করে না। ব্যাংকে জমা রাখা আপনার তথ্য যদি সবার কাছে চলে যায়, তবে টাকা চলে যাবে ব্যাংকের বাইরে—সোনাদানা, জমিজমা ইত্যাদির আকারে অথবা পাড়ি জমাবে বিদেশে। সোনা মনির তারই উদাহরণ। প্রশ্ন হবে টাকা যদি ব্যাংকে না রেখে অন্য কোনোভাবে রাখি, তবে কী হবে? দেশের লাভ না ক্ষতি? উত্তর স্পষ্ট। টাকা ব্যাংকে থাকলে তা দেখা যায়, বিনিয়োগ হয়। কিন্তু টাকা অন্যভাবে থাকলে তা দিয়ে কী হয়, এটি কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। দেশের অভ্যন্তরে এই টাকা রাখার বিপত্তি থাকলে তার গন্তব্য হবে বিদেশ। সেখানে কেউ টাকা দেখতে পাবে না। সেখানকার ব্যাংক আইন আমাকে রক্ষা করবে।

দ্বিতীয়ত, সব চলে যাওয়া টাকাই যে দুর্নীতির, তা কিন্তু বলা যাবে না। আমার টাকা, আইনসংগত আয় আমি কোথায় রাখব, সেই অধিকার কেবল আমারই। বলতে পারেন তাহলে বলে নিয়ে যাননি কেন? উত্তর সহজ, নিয়মমাফিক বিদেশে টাকা নেয়ার রাস্তা রুদ্ধ। অর্থাৎ আমি যদি আমার টাকা বৈধভাবে নিয়ে যেতে না পারি তখন অবৈধ পথই সম্বল। বৈধ পথে আমার টাকা নেয়ার রাস্তা নেই বলেই কিন্তু এতসব বাহানা। চলে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং। আপনাকে হতে হবে আমদানি কিংবা রফতানিকারক। তাহলেই তা করা যাবে। যে দেশে যাবে, সেখানে কি তারা বাধা দেয়? না। অতএব, একবারের জন্যও ভাববেন না যে দুর্নীতি ধরার জন্য অর্থ পাচার আইন করা হয়েছে। আমাদের মতো দেশে আপনার নিজের টাকাকেও বিদেশে নিতে বাধা দেয়া হয়, কারণ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট রয়েছে তাই। যেসব দেশে সেই সংকট নেই, তারা বাধা দেবে কেন? তবে হ্যাঁ, ১০ হাজার ডলারের বেশি টাকা নিলে তা প্রকাশ করতে হবে সে দেশে ঢোকার পর পরই। বৈধ আয় না অবৈধ আয়, তা বিবেচনায় আনা হয় না।  

অতএব, টাকা পাচার আর দুর্নীতি গুলিয়ে ফেললে চলবে না। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের খোঁজ নিতে বলেছেন। দুর্নীতিবাজ লোকজনকে ধরতে হলে তাদের কিন্তু দেশেই ধরতে হবে। বিদেশে ধরা যাবে না। সেখানে তারা ‘যথাযথ’ আইনি প্রক্রিয়ায় রক্ষা পেয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে দুর্নীতিবাজরা কিন্তু টাকা নিজেরা নেয় না। তাদের টাকা অন্যরা নিজ স্বার্থে পাঠিয়ে দেয়। আগেও বলেছি এখন ঘুষের আদান-প্রদান হয় বিদেশে। দেশে কাজ পাইয়ে দেয়ার বদলে বিদেশে তাদের পরিবারকে ভরণপোষণের টাকা পাঠানো হয়। 

তৃতীয়ত, দুর্নীতির টাকা দেশে ফেরত আনা যাবে কিনা? বিষয়টি আইনগত। তবে আমার ধারণা, আগে দুর্নীতির প্রমাণ দেবেন। প্রমাণ করতে হবে কোন পথে এ টাকা গিয়েছে। তারপর যে দেশে তা গেছে, সেখানের আদালতে যাবেন। অতপর দেখা যাবে। অতিসহজে তা ফেরত আনা সম্ভব নয়। কোনো কোনো দেশের সরকার দুর্বল হলে তারা তা ফেরত দিতে পারে। তবে টাকার ধর্মই হলো, যার কাছে তার। অতএব, দুর্নীতির টাকা ফেরত আসবে, এটি বেশ দূরের কথা। তা যদি সম্ভব হতো, তবে দুর্নীতিগ্রস্ত সবাই ইউরোপ-আমেরিকার নাগরিক হতে পারত না। ঔপনিবেশিক সময়ে তারা আশ্রয় দিয়েছে, যারা তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁবেদারি করেছে। আর আজ তারা তাদের আশ্রয় দেয়, যারা রাজনীতি পাল্টে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রকারী কিংবা সেইসব দুর্নীতিকারীদের, যারা টাকা নিজের দেশ থেকে তাদের দেশে নেবে। তার বাইরে আপনাকে তার দেশে কেন নেবে? সাধারণের জন্য যতদিন কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে ততদিন। আর আপনাকে নিয়ে গেলে আপনি স্বদেশে টাকা পাঠাবেন, স্বদেশের মাটির টান থাকবে, তাই তারা ব্যবস্থা করেছে গোটা পরিবারকে নিয়ে যাওয়ার অভিবাসন আইনের। কিছুদিন আগে দেখলাম এক বাংলাদেশীকে কানাডা বলেছে, তার মা-বাবাকে নিতে দেবে না। কারণ তার মা-বাবার চিকিৎসা খরচ সে দেশের সরকারকে বহন করতে হবে বলে। আর তাকে বলেছে, তাকেও তারা আর সে দেশে ঢুকতে দেবে না। কারণ? কারণ তার আয়ে মা-বাবার চিকিৎসা খরচ হবে না। প্রকারান্তরে বলছে, তুমি কানাডায় থাকলে তোমার মা-বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠাবে, তাতে কানাডার ক্ষতি হবে। অতএব, তোমাকেও কানাডায় থাকতে হবে না। অতএব, কী বুঝলেন? বোঝা গেল কানাডার সেই অভিবাসন কর্মকর্তা দেশপ্রেমিক। দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠানোর সম্ভাবনা রোধ করার জন্য তিনি তার ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। নচেৎ তার ওপর করের বোঝা বাড়বে। এই সহজ সত্য তিনি বোঝেন। আমাদের অসুবিধা হলো, জন্ম থেকেই আমাদের স্বপ্ন বিদেশে পাড়ি জমানো। কেউ বাকি নেই। দেশের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যন্ত সবারই বাসনা একদিন নিজে বিদেশে পাড়ি দেব অথবা ছেলেমেয়েরা পরদেশী হবে। কারণ দেশের ব্যবস্থার প্রতি আমাদের আস্থা সীমিত। বিশ্বাস ক্ষুদ্র।

আমরা তো সব দেশে যেতে চাই না? সেই দেশেই যেতে চাই, যেখানে আইনের শাসন রয়েছে। রয়েছে বিচারিক ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থায় রয়েছে আমার আস্থা। স্বদেশকে নিরাপদ মনে হচ্ছে না। বিষয়টি ভেবে দেখুন। আমার টাকা কেন আমার দেশে রাখতে পারছি না? দেশপ্রেমের অভাব, নাকি আইনের শাসনের অভাব, নাকি অযথা হয়রানির আশঙ্কা? অতএব, ঢালাওভাবে বলা যাবে না যে আমি দেশপ্রেমিক নই বলে বিদেশে টাকা পাঠাচ্ছি। বেশিদূর যেতে হবে না। বহু বিদেশী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেন। তাদের কি আমরা জিজ্ঞেস করি, আপনার আয় বৈধ নাকি অবৈধ পথে হয়েছে? আমরা তো বিদেশীদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টার খুলে রেখেছি টাকা নেয়ার জন্য। বিনিয়োগ গ্রহণ করার জন্য। অথচ দেশী বিনিয়োগকারীর জন্য রয়েছে একগাদা প্রশ্ন। অতএব, আপনি যদি নিরাপদে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চান, তবে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হলো, আগে বিদেশের নাগরিক হবেন। তারপর নিজে বিদেশী সেজে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবেন। বিদেশীরা নাগরিকদের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ। কারণ তার দেশ তাকে রক্ষা করবে। তাহলে কী দাঁড়াল? বাংলাদেশ সরকারই প্রকারান্তরে কি বলছে না যে টাকা বিদেশে নিয়ে যান। এর সঙ্গে দেশপ্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই।

চতুর্থত, যে দেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের অভাব রয়েছে, সে দেশে সব রাজনীতিকই থাকেন ভয়-ভীতির মধ্যে। কখন সরকার আমার ওপর বিরূপ হয়! কখন আমাকে অপছন্দ করে। বলছি না যে ভয়ভীতি কেবল বিরোধীদের মধ্যেই রয়েছে। সরকারি দলের মধ্যেও রয়েছে। তাই সবাই আখের গোছানোর জন্য বিদেশে স্ত্রী-সন্তানাদিকে পাঠিয়ে দেন। ভিসা করিয়ে রাখেন। পা একটা দেশের বাইরে রাখেন। যেন সুযোগ বুঝে পাড়ি জমানো যায়। কেবল দুর্নীতি নয়, কভিডের ভয়েও অনেকে দেশে প্রবেশ করছেন না। বাইরে পা রাখার এমন ব্যবস্থা কেন হাতছাড়া করবেন। অতএব, বিদেশী নাগরিকত্ব তৈরি করতে হবে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে চিকিৎসার নামে সেই দেশে নিয়ে যাবেন, যাতে সেখানে জন্মেই নাগরিকত্ব নিয়ে দেশে ফেরত আসা যায়। এ নিয়ে বিদেশের পত্রিকায়ও নানা রসালো গল্প আছে। শুধু তাই নয়, সন্তানসম্ভবা মা কতদিন পর প্লেনে উঠতে পারবেন না, তা নিয়ে অংক কষে ‘সময়মতো’ পাড়ি দিয়েছেন, এমন মায়ের সংখ্যা এ দেশে কম নয়। তাদের কী অপরাধ? তারা কিংবা তাদের পরিবার নিজ দেশকে ভয় পান। কেন ভয় পান? তার অনেক গল্প রয়েছে। কেউ ভয় পান রাজনীতিকে। কেউ ভয় পান দুর্নীতি দমন কমিশনকে। কেউবা রোগবালাইকে। কেউ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইত্যাদি। ভয়ের কারণগুলোর দিকে তাকান। তারপর তা দূর করার জন্য প্রয়োজনে কমিশন করে আইনি কাঠামো বদলান। তবেই দেখবেন দেশকে সবাই ভালোবাসবে। এমনকি বিদেশীরাও বাংলাদেশকে ভালোবাসবে। যেমনটি আমরা বাসি বিদেশকে। দোষ ব্যক্তির নয়, দোষ সমষ্টির। সামাজিকভাবে তা বদলাতে আমাদের ভাবতে হবে। 

পঞ্চমত, দুর্নীতিবাজরা দেশে টাকা রাখতে ভয় পায়। তাই তারা টাকা বিদেশে পাঠাতে চায়। কারণ সব দেশই আমাদের মতো বিদেশ থেকে টাকা এলে বলে ওয়েলকাম। অতএব, দুর্নীতিবাজরা যে টাকা বাইরে নেবে, তা বলা বাহুল্য। পার্থক্য অন্যখানে। দুর্নীতির টাকা আজকাল নিজেকে পাঠাতে হয় না। বিদেশে টাকা পৌঁছে দেয়ার লোক আছে। যারা ঘুষ দেয়, তাকেই বলে দিন আমার স্ত্রী অমুক শহরে রয়েছে, তাকে টাকা পাঠান, আপনার কাজ হয়ে যাবে। আমার হাতই লাগল না এই টাকায়। এই টাকার সূত্র খুঁজে বের করা বেশ কষ্টকর। দেখবেন অনেকের স্ত্রী-পরিজন বিদেশেই থাকেন। দেশে আসেন বেড়াতে। তাদের নিয়ে সরকারের ভয় বেশি হওয়ার কথা। কারণ কেবল দুর্নীতি নয়, দেশ বিক্রি করাও তাদের জন্য অসম্ভব নয়। টাকার বিনিময়ে দেশের গোপন তথ্য বিদেশী সরকার বা অন্য কাউকে পাঠাতে অনেকেই কুণ্ঠা করবেন না। 

সব শেষে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আমাদের বিচারিক ব্যবস্থা, আমাদের আইনি কাঠামোর পরিবর্তন অত্যন্ত প্রয়োজন। তবেই সৎ-সত্যবান কোনো নাগরিক বিদেশে পাড়ি জমাবেন না। তবে অসৎ ব্যক্তিরা তা সবসময়ই করবে। তাদের জন্য আমাদের চিন্তা হবে ভিন্ন। দেশকে যদি আমরা ভালোবাসি, তবে আমাদেরই বুঝতে হবে। দেশকে বসবাসযোগ্য তৈরি করার উপযোগী আইনি কাঠামো আমাদের চালু করতে হবে। ঔপনিবেশিক আইনি ব্যবস্থায় তা হবে না। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিকে অপরাধী ভাবা হয়, সরকারকে নয়। ঔপনিবেশিক শাসক কখনই নাগরিককে শ্রদ্ধা করতে শেখায়নি। ইংরেজদের ভাষায় মূল দেশীদের বলে নেটিভ, কোথাও এবঅরিজিনাল, কোথাও ইন্ডিয়ান, কোথাও এস্কিমো, কোথাও নিগার। সব শব্দই অসম্মানজনক। সব শেষে যাদের টাকা নেই কিংবা ক্ষমতা নেই, তারা কিন্তু বিদেশ নিয়ে ভাবেন না। এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে তারাই দেশপ্রেমিক। আশা করি, সবাই দেশকে নিয়ে ভাববেন।


ড. এ. কে. এনামুল হক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি 

পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন