কভিড টিকা নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে ঝড় উঠেছে। সবাই টিকা চায়। সবাই সবার আগে চায়। টিকার প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষ, তাই সবাই-ই এখন ব্যবহার করছে পরীক্ষামূলকভাবে। অর্থাৎ টিকার গবেষণার অংশ হিসেবে সবাই টিকা দিচ্ছে। এরই মধ্যে টিকার ঝড়ে বেসামাল বিশ্বনেতারা। ট্রাম্প সাহেব ভেসে গেছেন কভিডের ধাক্কায়। বরিস, মোদি ও মাঁখো প্রায় যেতে বসেছিলেন, তবে টিকা তাকে সামাল দিয়েছে। টিকা নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে এক দফা ঝগড়াও হয়েছে ইউরোপের। ইউরোপও প্রায় বেঁকে বসেছিল, তবে শেষ পর্যন্ত সামাল দিয়েছে। আমার এক বন্ধু জানালেন টিকা দেয়ার জন্য তিনি আমেরিকায় গিয়েছেন। একসঙ্গে দুই দেশের নাগরিক হলে অনেক সুবিধে। গাছের আগাও খাওয়া যায় আর শিকড়ও পাওয়া যায়। তাদেরই একজনের ফেসবুকের পোস্ট দেখে অনেকেরই মর্মবেদনা হয়েছে। কী দেশে জন্মেছিলাম রে! ভাগ্য। কিন্তু আমরা গরিব, তাই আমাদের ভাগ্যে টিকা নেই! তবে এও মনে হয়েছে, আমাদের আল্লাহ আছেন, তাই তো বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে এখন বলতে দ্বিধা নেই যে সেই দিন আর নেই। বাংলাদেশের অনেকেই এখন টিকার পোস্ট দিচ্ছেন। সেদিন এক মার্কিনি বন্ধু বলল, আরে তোমরা তো আমাদের চেয়ে এগিয়ে! কী বলো? দেখো, তোমরা এখন চল্লিশোর্ধ্বকেও টিকা দিচ্ছ কিন্তু আমরা এখনো ষাটোর্ধ্ব বয়স্কদেরই দিচ্ছি। কিছু বললাম না! গর্বটাই থাকুক।
যাই হোক, কথা সত্য। সেই দিন আর নেই। তবে কৌতূহল আর প্রশ্ন এখন সবার মনে। টিকা দেব কি দেব না? প্রশ্নের উত্তর হয়তোবা আমরা কেউই সঠিক জানি না। তবে সবাইকে বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করার জন্য এ লেখা। বাড়িতে গিয়েছি। ভাইবোন আর মায়ের সঙ্গে দেখা হবে অনেকদিন পর। কিন্তু টিকার গল্প পিছু ছাড়ে না। শুরু হয় কোন টিকা ভালো তা নিয়ে আর শেষ হয় ‘না বাবা একটু দেখো’ দিয়ে। বুঝতেই পারছেন, আমাদের সবার মনে নানা প্রশ্ন। আর প্রশ্নের উত্তর সবাই মেলাচ্ছে ফেসবুকে। ফেসবুক দিয়েই আমরা হাসি, আমরা কাঁদি কিংবা আমরা ভাবি। এ এক অদ্ভুদ জগৎ। এখানে কি নেই? এখান সবাই কথা বলে। সবাই শুনে। সবাই তার মত প্রকাশ করে। স্বাধীন মতামতের এ এক অপূর্ব মাধ্যম। কাউকে অপদস্ত করবেন, ফেসবুকে পোস্ট দিন। কারো প্রতি সহমর্মিতা দেখাবেন, লাইক দিন। ঘৃণা দেখাবেন, ডিসলাইক দিন কিংবা ব্লক করুন। ছোটকালে স্বপ্নে দেখে একজন আরেকজনকে বলতে শুনেছি, আজ অমুককে স্বপ্নে দেখলাম, তাকে মনে পড়েছে। এখন ছবি পোস্ট করুন। দেখবেন ফেসবুক তাকে বের করে বলে দেবে, আপনাকে অমুকের মনে পড়েছে! কথায় বলে, ঈর্ষা সৃষ্টির একটি কৌশল হলো লোককে নিজের বিষয়ে বলুন। আগেকার দিনে তা প্রকাশ করার জন্য জবরদস্ত জামাকাপড় পরত। বিয়েশাদির আসরে তা পরলেই নজরে আসত অন্য লোকের। তাতেই কাজ হতো। কেউ না কেউ ভাবত আহা, আমার ওটা নেই, সে কী ভাগ্যবান! আমার পোড়া কপাল ইত্যাদি। কথা প্রসঙ্গে আমার ছোট ভাই একটি গল্প শোনাল। এক ভাবীর ফেসবুকের পোস্ট কমে গেছে দেখে অন্য ভাবী জিজ্ঞেস করছেন, ভাবী আপনার ফটো আপলোড কমে গেছে কেন? আর বলবেন না ভাবী, আমার মেয়েটা বাড়ি চলে গেছে। ভালো ছবি তুলতো সে। তাকে দিয়েই ছবি তুলে আমি পোস্ট করতাম কিন্তু সে নেই। ভালো একটা মেয়ে পাচ্ছি না। যাদের পেলাম, তাদের ইন্টারভিউ নিলাম। ওদের ছবি তোলার জ্ঞান কম। রাখিনি এখনো। খুঁজছি একটি মেয়ে! অপার এই স্বাধীনতার এমন এক যুগে আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না কী করা উচিত? টিকা দেব কি দেব না!
ভাইবোনদের মেলা বেশ মজার। সবাই এক মায়ের হলে কী হবে, সবাই ভিন্ন। মাঝে মাঝে মনে হয়, মায়ের ভাবনাটা কেমন? তিনি কী ভাবছেন? এক জঠরে জন্মেই এমন পৃথক সত্তাগুলো কী করে সৃষ্টি হয়? নিজে মা নই, তাই মায়ের ভাবনা বুঝতে পারি না। এক পেটে জন্মে, এক খাবার খেয়ে, এক বিদ্যালয়ে পড়েও কেন এত পার্থক্য? প্রশ্নটি তোলা থাকল আপনাদের জন্য। যাহোক, একজন জিজ্ঞেস করল, কি বল টিকা দেব? বললাম তোমার কী মত? না দেব না। কেন? কেন তুমিই না লিখেছিলে টিকা এখনো পরীক্ষাগারে রয়েছে? তা ঠিক। তবে আমি তো না করিনি। বিশ্লেষণের জন্য তথ্য সবার নজরে এনেছি মাত্র। বুঝিয়েছি যে টিকা বাজারে আসতে সময় লাগে। যেকোনো টিকা শতভাগ কখনই কার্যকর হয় না। নানাভাবে পরীক্ষা করা হয়। সর্বশেষ স্তরের পরীক্ষায় দেখা হয়, টিকা কার ওপর কার্যকর, কার ওপর নয় কিংবা কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় বা তার মাত্রা কেমন। এমনতর পরীক্ষা শেষ হতে ২০২১ চলে যাবে। তবে তার মানে এই নয় যে টিকা দেয়া যাবে না। না দিলে পরীক্ষা হবে কী করে? এজন্যই দেখবে এখন যারা টিকা দেবে, তাদের কিন্তু একটি ছাড়পত্রে সই দিতে হবে। আমি সজ্ঞানে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জেনেই টিকা নিতে ইচ্ছুক। তাহলে? আমি গিনিপিগ হব না। তোমরা দাও। আরেকজন বলল, টিকা দেয়া আর না-দেয়া সমান। টিকা দেয়ার পরও কিন্তু মাস্ক পরতে হবে। সাবধানে থাকতে হবে। হাত ধুতে হবে। তবে দিয়ে কী লাভ? বললাম তা সত্য। একটি দেশে বা সমাজে ৭০ শতাংশ বা তার বেশি লোক টিকা না নেয়া পর্যন্ত ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই টিকা দেয়া মানে এই নয় যে আমাদের সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিতে হবে। আমাদের ১৬ কোটি লোক। তাই অন্তত ১০-১১ কোটি টিকার আওতায় না আসা পর্যন্ত তা শেষ হবে না। তাহলে? বললাম আরো আছে, টিকার মেয়াদ। মানে? মানে টিকার মেয়াদ কতদিন পর্যন্ত তা এখনো আমরা সঠিক জানি না। আপাতত এক বছর। অর্থাৎ আগামী বছর আবার টিকা দিতে হতে পারে। হুম। কিন্তু এক বছরে ১০ কোটির টিকা না দেয়া হলে তো সেই শূন্যেই ফেরত যাব! বললাম আপাতত কর্মক্ষম জনগণের ৭০ শতাংশ টিকার আওতায় আনতে পারলেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনো প্রশ্ন থাকবে না। তার মানে? তার মানে হলো, চল্লিশোর্ধ্ব জনগণের পাঁচ থেকে ছয় কোটি লোকের টিকা হলেই আমরা আপাতত নিরাপদ হব। বুঝলাম, কয়দিন লাগবে জানো? বললাম যদি আমরা দিনে দুই লাখ টিকা দিই, তবে লাগবে ২৫০ দিন, পাঁচ লাখ করে দিলে লাগবে ১০০ দিন। হুম। তাহলে? এত ক্ষমতা কী রয়েছে? এত টিকা কি আমরা কিনতে পারব? কে দেবে? সব দেশেরই একই সমস্যা। সবাই চাইবে তার নিজের অর্থনীতি সচল করতে আর তাই সবাই তার দেশে টিকা দিতে চাইবে সবার আগে।
কথা সত্য। তবে উপায়? উপায় কয়েকটা রয়েছে। আপাতত এত টিকা আমদানি সম্ভব হবে না। তা করতে গেলে দেশের সার্বিক অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে যাবে। এমনিতে আমাদের নূন আনতে পানতা ফুরায়। তাই এই পথে যাওয়া সম্ভব হবে না। প্রথমত, জরুরি টিকার জন্য আমাদের নির্ভর করতে হবে কিছুটা কেনা, কিছুটা বন্ধুদেশের দান ও কিছুটা কোভ্যাক্সের সহায়তার ওপর। যা দিয়ে এখন চলছে। অতএব টিকা যতদিন থাকবে ততদিন টিকা চলবে। এরপর? দ্বিতীয়ত, সহসাই টিকার ব্যবসা চালু হবে। এরই মধ্যে দেশের এক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান টিকার বাণিজ্য করার জন্য লাইসেন্স নিয়ে বসে আছে। তাই এক সময় সরকার বলবে, যারা পারো নিজের পয়সায় টিকা দাও। তবে হ্যাঁ, বলতে পারো টিকা উৎপাদনকারী দেশ কি তার টিকা রফতানির অনুমতি দেবে? আমার ধারণা দেবে, তবে তা হবে অনেকটা বাংলাদেশের ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির মতো। মানে? মানে ভারতে যখন পেঁয়াজের সংকট হয় তখন কিন্তু তারা পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে না কেবল, রফতানি দাম বাড়িয়ে দেয়। বলে পেঁয়াজ রফতানি করতে হলে এত টাকা দরে এলসি খুলতে হবে। তাতেই কাজ হয়। আমাদের আমদানিকারকরা দেখে ওই দরে আমদানি করলে বাজারে পেঁয়াজের ক্রেতা পাওয়া যাবে না, তাই তারা আমদানি বন্ধ করে দেয় আর পত্রিকা লিখে ভারত রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। তাই দেখবে এক্ষেত্রেও অনেক দেশই আগামী জুন-জুলাইয়ের পর রফতানির অনুমতি দেবে এই শর্তে যে তার দাম প্রকৃত দামের দুই থেকে পাঁচ গুণের মতো হবে। তাতে লাভ দুই দেশেরই। কী রকম? তারা অধিক দরে রফতানি করে যে লাভ করবে, তা দিয়ে নিজ দেশে বিনে পয়সার টিকা দেয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে অথবা তাদের নিজ দেশে টিকার দাম কমিয়ে দেবে। আর আমাদের মতো দেশ বলবে, টিকা বাজারে আছে, কিনে দিয়ে দাও। আমাদের বিনে পয়সার টিকায় তো এখনো অনেকের আগ্রহ নেই! জুন-জুলাই কেন? জুন-জুলাই বললাম, কারণ তার আগে তারা নিজেদের জরুরি টিকার প্রয়োজনীয়তা ফুরাতে পারবে না। তাহলে আমাদের কপাল খুলছে না দেখছি। কথাটা সত্য, তবে আরো একটা পথ রয়েছে। কী সেটা? তৃতীয়ত, ডব্লিউএইচওর কোভ্যাক্সের আওতায় কিছু টিকা আসবে। তবে তাদের সমস্যা অনেক। কেবল গরিব দেশে টিকা লাগবে ২৫০ কোটি লোকের। তার জন্য টাকাও লাগবে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। ডব্লিউএইচও ধনী দেশগুলোকে বলছে এই টাকার জোগান দিতে। ইউরোপ ও চীন ছাড়া অনেকেই এখনো তেমন আগ্রহ দেখায়নি। তবে?
আমাদের ভাবতে হবে নিজের দেশে টিকা উৎপাদনের। সেজন্য প্রয়োজন উৎপাদনের লাইসেন্স গ্রহণের। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি যেমন দেশে ওষুধ তৈরির লাইসেন্স নেয়, তেমনি টিকা উৎপাদনের ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে হবে। সরকার সেজন্য ডব্লিউএইচওর সহায়তা নিতে পারে। প্রয়োজনে সরকার অন্য বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোকে এই লাইসেন্স প্রদানের অনুরোধও করতে পারে। ডব্লিউএইচও চার-পাঁচ মাস ধরে একই কথাই বলে আসছে। তারা বলছে, টিকা সব দেশে পৌঁছাতে না পারলে পৃথিবী নিরাপদ হবে না। বর্তমান প্রক্রিয়ায় টিকা কেবল ধনী দেশ বা ধনীদের দখলে রয়েছে। এ ব্যবস্থা পৃথিবীর জন্য মঙ্গলজনক নয়। বহু গরিব দেশ টিকা কেনার সামর্থ্য রাখে না। তাই আপাতত ধনী দেশের উচিত গরিব দেশে টিকা পৌঁছে দেয়ার জন্য ডব্লিউএইচওর কোভ্যাক্সে অর্থ সাহায্য করা। তাতে ডব্লিউএইচও গরিব দেশে বিনা মূল্যে টিকা সরবরাহ করতে পারবে। আমাদের দেশেও কিছু টিকা আসছে এর আওতায়। ডব্লিউএইচওর দ্বিতীয় প্রচেষ্টা হবে টিকার উৎপাদনের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বিশ্বে পরিচিত। তাই আমাদের উচিত টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থায় যোগ দেয়া। তাতে আমরাসহ বিশ্ব লাভবান হবে। কিন্তু! প্রশ্ন থামে না। টিকা বাণিজ্যের কী হবে? যারা টিকার বাণিজ্য অর্থাৎ আমদানির জন্য শতকোটি টাকা তাদের ভাষায় ‘বিনিয়োগ’ করেছে, তাদের কী হবে? দেখো, বিনিয়োগ আর অগ্রিম এক নয়। আমরা অনেক সময় অনেক পণ্য কেনার জন্য অগ্রিম বুকিং অর্থ দিই, তাকে বিনিয়োগ বলা যাবে না। বিনিয়োগ অর্থ উৎপাদন ব্যবস্থায় যোগ দেয়া। মালিকানায় শরিক হওয়া অথবা অর্থ লগ্নি দেয়া। আমার জানামতে আমাদের দেয়া ওই অর্থ কেবল বুকিং মানি। তাদের ব্যবসা নিয়ে সরকারের ভাবনা থাকার কথা নয়, কারণ ব্যবসা মানেই ঝুঁকি। তা সব ব্যবসায়ী জানেন। সর্বোপরি, যে ওষুধ এখনো পরীক্ষাগারে তা কিনতে অগ্রিম অর্থ দেশ থেকে বিদেশে যায় কী করে? এমনও হতে পারত যে দেখা গেল ওষুধটি অকার্যকর। তখন সরকার তা আমদানি করতেই দেবে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় বা পাচার হবে। দক্ষিণ আফ্রিকা একটি টিকার ক্ষেত্রে তা-ই করেছে। ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। তাদের ভাবনা আর সরকারের ভাবনা এক নয়।
আমাদের মূল প্রতিপাদ্য হলো দেশে টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা করা, তা পরীক্ষার জন্যই হোক কিংবা রফতানির জন্যই হোক। বাণিজ্য আর উৎপাদন এক নয়। আর আমাদের বুঝতে হবে পৃথিবীতে কেবল একটি টিকা নয়। অন্তত অর্ধডজন সংখ্যক টিকা এখন চূড়ান্ত পরীক্ষা স্তরে রয়েছে। তার সব কয়টি দেশে পরীক্ষামূলক উৎপাদনের চুক্তি করা যায়। যারা আগে আসবে তাদের কাছেই থাকবে ১৬ কোটি মানুষের বাজার। জনসংখ্যায় পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ। অতএব, কেউ না কেউ আমাদের উৎপাদনের শর্তে লাইসেন্স দেবে। আমাদের উচিত হবে দেশের ও জনগণের স্বার্থে এ পথে এগোনো।
আচ্ছা, তবে কোন টিকা দেব? পরীক্ষামূলক টিকা কি কার্যকর? প্রথমত, আমাদের বুঝতে হবে আমরা এমন এক সংকটে রয়েছি, যেখানে টিকাদান জরুরি। পরীক্ষা শেষ করার মতো অপেক্ষা করার সময় আমাদের হাতে নেই। দ্বিতীয়ত, কোনো টিকাই শতভাগ কার্যকর হয় না। কোনোটি বেশি কোনোটি কম। কোনো টিকা এক ধরনের ভাইরাসে অধিক কার্যকর কোনোটি অন্য ধরনের। অতএব, এই টিকা ওই টিকার চেয়ে ভালো এমনতর বক্তব্য অবান্তর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন টিকা দেয়া হচ্ছে। ইসরায়েল ও ইউরোপ দিয়েছে ফাইজারের টিকা, ভারত ও ব্রিটেন দিয়েছে অক্সফোর্ডের টিকা, যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে অনেকগুলো, কারণ তারা বড় দেশ; রাশিয়া দিয়েছে স্পুটনিক টিকা, চীন দিয়েছে সিনোভ্যাক্সসহ আরো একটি। সবগুলোই কার্যকর, তবে মাত্রা ভিন্ন। আমরা একটি বড় দেশ। সব কোম্পানিই টিকার ব্যবসা করবে। ব্যবসা দুভাবে করা যায়। বাণিজ্য ও উৎপাদন। আমাদের মতো বড় দেশ তাই সবাইকেই আহ্বান জানাবে উৎপাদনে আমাদের সহায়তা করতে। প্রতি বছর টিকা আমদানি করতে হলে উৎপাদন ছাড়া গতি নেই। কোভ্যাক্সের আওতায়ও উৎপাদন করা সম্ভব। আমাদের দেশে তো একই রোগ নিরাময়ের জন্য নানা কোম্পানির ওষুধ পাওয়া যায়। টিকার ক্ষেত্রেও তা হবে। তৃতীয়ত, একটু আগেই তো বললাম, কিছুদিনের মধ্যে কিন্তু ফ্রি টিকার জোগান সীমিত হয়ে যাবে। তা কেবল থাকবে নির্দিষ্ট কিছু পেশার লোক ও গরিবদের জন্য। বাকিদের জন্য নিজ অর্থে টিকা কিনতে হবে। আমাদের অনেকেই কিন্তু পোলিও টিকা নিজ অর্থে কিনে সন্তানকে দিয়ে থাকে আর অনেকে বসে থাকি সরকারের পোলিও দিবসের জন্য। এক্ষেত্রেও তা-ই হবে।
টিকার অভিজ্ঞতা কেমন? আমি নিজে এখনো সুযোগ পাইনি। তবে যাদের জানি তাদের অভিজ্ঞতা খারাপ নয়। রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবীদের একটি দল প্রতিটি কেন্দ্রে সহায়তা করছে। টিকা দেয়ার আর কোনো বিশেষ কিছু অভিজ্ঞতা লাগে না। সেই ছোটকালের টিকা দেয়ার মতোনই। অনেকেই ভয়ে স্কুল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, ভয় টিকায় ছিল না, ভয় ছিল সুইয়ে। এখানেও তা-ই। একই রকম। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? অধিকাংশই কিন্তু একই রকম। জ্বর হতেও পারে, আবার না-ও। শরীর একটু ম্যাজম্যাজ করতে পারে। আবার না-ও। বড় কিছু হলে ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে। আর ডাক্তারের কাছে গেলেই যেহেতু টিকাটি পরীক্ষামূলক, তাই তার সব ডাটা চলে যাবে মূল টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। তারা জানবে কী কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, কাদের হয় ইত্যাদি। এই অভিজ্ঞতার আলোকে আরো নিরাপদ টিকা আবিষ্কার হবে, এই আশায়ই থাকব।
ড. এ. কে. এনামুল হক: অর্থনীতির অধ্যাপক
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট